বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:০৯ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
রংপুর ব্যুরো॥
রংপুর জেলা প্রশাসন ও মেট্রোপলিটন পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হজ্বে যাওয়ার সুযোগে মাত্র ১০ দিনে গোপনে দেড় হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এই লাইসেন্স দিয়ে ৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুটপাটের মহোৎসবের অভিযোগ উঠেছে করপোরেশনের দুই প্যানেল মেয়রের বিরুদ্ধে। তারা নিজেদের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পরিচয় দিয়ে কর্মকর্তাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে লাইসেন্স দিতে বাধ্য করেছেন। এর ফলে নগরবাসীকে যানজটের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে রংপুর সিটি কর্পোরেশনেরমেয়রের হজ্বে যাওয়ার সুযোগে লাইসেন্সপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়ে গোপনে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এনিয়ে নগরীর সুধি মহলসহ নগরবাসীর মাঝে চাপা ক্ষোভ দেখা দেয়ায় সিটি মেয়র মোস্তফাফিজার রহমান মোস্তফা লাইসেন্স বাতিল করেছেন। অন্যদিকে দুই প্যানেল মেয়র সাংবাদিক সম্মেলন করে নিয়ম মেনেই লাইসেন্স দেয়া হয়েছে এতে কোন অর্থ লেনদেন হয়নি বলেও দাবি করেন। এনিয়ে সিটি মেয়র ও দুই প্যানেল মেয়র মুখোমুখি অবস্থান করছেন।
গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি বলেন, হজ্বে যাওয়ার সময় দুই প্যানেল মেয়রকে রুটিন দায়িত্ব পালনের কথা বলে গেছেন কিন্তু কোন আর্থিক ক্ষমতা তাদের দেয়া হয়নি। তারা অবৈধভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দিয়েছে। যা আমি বাতিল ঘোষণা করেছি।
রংপুর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, উত্তরের রংপুর বিভাগীয় মহানগরীতে এমনিতেই ৫ হাজার অটোরিকশাসহ এক হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া আছে। অথচ মহানগরীতে অবৈধভাবে অটোরিকশা আর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার যার বেশিরভাগ অবৈধ। ফলে প্রতিদিনই যানজটে নাকাল হচ্ছেন মহানগরবাসী। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ নতুন করে কোন অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স না দেয়ার জন্য করপোরেশনকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে।
সিটি করপোরেশন সূত্রে আরও জানা গেছে, এবার পবিত্র হজ পালনের জন্য সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা হজ করতে যাওয়ার আগে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ হিসেবে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার শামসুল ইসলাম এবং প্যানেল মেয়র-২ হিসেবে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মাহমুদুর রহমান টিটোকে তার অনুপস্থিতিতে করপোরেশনের রুটিন দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুই প্যানেল মেয়র শামসুল ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান টিটো নিজেদের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পরিচয় দিয়ে লাইসেন্সপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে মাত্র ১০ দিনে এক হাজার ৬৩৪টি ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স প্রদান করেছেন। যেখানে রিকশার লাইসেন্স প্রদান করতে সিটি করপোরেশনকে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয় সেখানে লাইসেন্সপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এব্যাপারে রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, রংপুরে গরিব সহায়-সম্বলহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে অনেকেই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে তদবির করলেও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ মেট্রোপলিটন পুলিশ ও প্রশাসনের অনুরোধের কারণে লাইসেন্স প্রদান বন্ধ রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, এবার পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করাকালীন গোপনে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরে মক্কা থেকে ফোন করে লাইসেন্স শাখার কর্মকর্তাদের লাইসেন্স না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই প্যানেল নিজেদের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পরিচয় দিয়ে উল্টো কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে লাইসেন্স দিতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ করেন সিটি মেয়র। তবে গতকাল বুধবার দুই প্যানেল মেয়রের দেয়া লাইসেন্স বাতিল করেন সিটি মেয়র।
এদিকে সিটি করপোরেশন সূত্র আরও জানায়, দুই প্যানেল মেয়র শামসুল ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান টিটো ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিটি করপোরেশনের তহবিলে লাইসেন্স প্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা করে তিন কোটি টাকারও বেশি অর্থ লুটপাট করেছেন।
এ ব্যাপারে লাইসেন্স শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, তাদের লাইসেন্স দিতে বাধ্য করা হয়েছে ফলে করণীয় কিছুই ছিল না। একই কথা বলেন লাইসেন্স শাখার অন্য কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে রংপুর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহবুবার রহমান মঞ্জুসহ বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশনের সভায় ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়ার কোন সভা হয়নি সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই প্যানেল মেয়র তাদের অবৈধভাবে লাইসেন্স দিয়েছেন এক্ষেত্রে কাউন্সিলরদেরও অন্ধকারে রাখা হয়।
রংপুর নগরীর শালবন এলাকার আবদুল মালেক, মুন্সিপাড়ার সাহাব উদ্দিন, শালবনের মমিন ও কেরানীরহাটের আমিনুল হকসহ বেশ কয়েক জানান, তাদের কাছে ৪০ হাজার টাকা আগাম নিয়ে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন তহবিলে জমা দেয়া হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
সিপিবি সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশনে অনেক ধরনের দুর্নীতি আর অনিয়মের কথা শুনেছি। তার মধ্যে তড়িঘড়ি করে দেড় হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়ার ঘটনা জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
এব্যাপারে সুজন মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফকরুল আনাম বেঞ্জু অভিযোগ করেন, মেয়রের অনুপস্থিতিতে মেয়র দুই প্যানেল মেয়রকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করার কোন লিখিত নির্দেশ দিয়েছেন কি না সেটা মেয়রকেই প্রমাণ করতে হবে। এমনতিইে রংপুর যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে, এত অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া উচিত হয়নি। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে দুই প্যানেল মেয়র শামসুল ইসলাম ও মাহমুদুর রহমান টিটোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।