মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর:
উজানের ঢল ও ভাড়ি বর্ষণে তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে শুক্রবার পানির উচ্চতা কিছু কমলেওতা বিপদসীমার উপরেরই রয়েছে। ইতোমধ্যেই তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ কমবেশি পানিবন্দি হয়ে আছে। তলিয়ে গেছে বাদাম, ভুট্টা, সবজিসহ উঠতি ফসল। এদিকে দুর্গত মানুষজনেরা এখনো সরকারী-বেসরকারী কোন প্রকার ত্রাণ সামগ্রী পায়নি। তবে সরকারী দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে। যা বিতরণ করা হবে।
তবে এসব অঞ্চলের মানুষজন দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রাণসহ সরকারী সহায়তা ও ভাঙ্গন মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি করেন।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, তলিয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষিটারী, সদর, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, হারাগাছ, টেপামধুপুর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও তাম্বলপুর ইউনিয়নের তিস্তার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বাদাম, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ধানসহ বিভিন্ন ফসলি জমি। হাজার হাজার বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকেছে। অনেক বাড়িতে এখন কোমর পানি।
গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষিটারী ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে পানিবন্দি বয়স্ক ও শিশুদের নৌকায় করে উঁচু স্থানে নেয়া হয়েছে। বন্যা এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনা খাবারের তীব্র সঙ্কট বিরাজ করছে। ভুক্তভোগীদের জন্য এখনো কোনো ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেনি কেউ। এদিকে তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে ধরেছে তীব্র ভাঙ্গন। মানুষ অনেক কষ্ট করে বাড়ি-ঘর সরিয়ে নিচ্ছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানান, বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে ডালিয়া ব্যাজার পয়েন্টে তিস্তার পানি বৃহস্পতিবার রাতে ১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে শুক্রবার সকাল ৯টায় তা পাঁচ সেন্টিমিটার নিচে নেমে আসে। এখনো পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি আরো জানান, আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে আবারো বিপদসীমা অতিক্রম করবে। এই পূর্বাভাস আমরা দুই-এক সপ্তাহ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। যাতে নদী অববাহিকার লোকজন নিরাপদে অবস্থান নিতে পারেন। গবাদিপশুসহ অন্য জিনিস সরিয়ে নিতে পারেন। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, তিস্তায় পানি বাড়ায় নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত তিস্তা অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও বাড়িতে কোমর পানি।
এসব এলাকার উঠতি ফসল বাদাম, আমনের চারা, ধান, পাট, ভুট্টা সবজিসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় মানুষ খুবই বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্টটা চরমে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে আছেন অনেকে। কোথাও সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পৌঁছেনি এখনো। গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষিটারী পশ্চিম ইচলি গ্রামের পানিবন্দি সামিনা বেগম বলেন, ‘হামরা পানিত মরি যাওসি। হামরা যে কয়দিন থাকি পানিত পরি আচি কেউই তো আইসলেন না। কই রান্দি কই বাড়ি, ছোট ছাওয়া পোয়াক ধরি কই যাই। চকির ওপররোত চকি দিয়া কোনোমতে আইত কোনা নিয়া যাই। নেম্বার-চেয়ারম্যানেরা এতি ভুলকি দিয়াও দ্যাকে না।’
একই এলাকার বয়োবৃদ্ধা ফাতেমা খাতুন জানালেন, ‘হামরা ১৫ দিন থাকি পানিত। নেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাঁচি আচি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই। তোমরাগুলি খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামারগুলার জইন্যে কিছু করেন।’ লক্ষিটারী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মনেয়ারুল ইসলাম জানান, আমরা নৌকা দিয়ে বৃদ্ধ এবং শিশুদের উঁচু স্থানে নিয়ে আসছি। কোনো সহযোগিতা করতে পারিনি। ওপরে জানিয়েছি। তারা এখন পর্যন্ত আসেওনি।
লক্ষিটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল-হাদী জানান, আমার ইউনিয়নে বৃদ্ধা নারী-পুরুষ ও শিশু আছে, তাদেরকে আমরা নিরাপদ স্থানে এনেছি। আমার ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ডের ইতোমধ্যেই ১০ হাজার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পানিবন্দি কোনো মানুষকে আমরা সহযোগিতা করতে পারিনি। তবে ইউএনও মহোদয়কে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সাহায্য এখনো পাওয়া যায়নি।
কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানান, তার ইউনিয়নের ছয়টি ওয়ার্ডের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবারের সংকট বিরাজ করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তাদেরকে কিছুই দিতে পারি নাই।
নোহালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ টিটুল জানান, ওই ইউনিয়নের ১৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের খাবারের তীব্র সঙ্কট বিরাজ করছে।
মর্ণেয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তিনিও এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো খাদ্য সহায়তা দিতে পারেননি।
গজঘণ্টা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, প্রতিদিনই তার ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। মানুষ পানিবন্দি হচ্ছে। বাদামের সব ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
এদিকে কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী জানান, বন্যা আর ভাঙ্গন আমার ইউনিয়নের দুই হাজার পরিবারকে বিপদের মধ্যে রয়েছে। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ১১৯ দশমিক ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এরশাদ উদ্দিন জানান, পিআই ও উপজেলা প্রকৌশলীকে সাথে নিয়ে তিস্তা পাড়ের পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শন করেছি। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে। দ্রুত পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।