শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর:
প্রভাব বিস্তার, সংঘাত ও কোন্দলের আশঙ্কায় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের স্বজনদের নির্বাচনে প্রার্থী না হতে নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসন্ন সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন রংপুর বিভাগের কয়েকজন সংসদ সদস্যের স্বজনরা। নীলফামারি, ঠাঁকুরগাও, লালমনিরহাট জেলায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের স্বজনরা প্রার্থী হয়েছে। এনিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সংর্ঘাতের আশষ্কা করছেন নেতাকর্মীরা। তারা চরম ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র ও স্থানীয় মাধ্যমে জানাগেছে, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে রংপুর বিভাগের নীলফামারি, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও সহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র কোন্দাল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তার স্বজনরা নিজেদের অধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার ধরে রাখতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। অথচ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার, সংঘাত ও কোন্দলের আশঙ্কায় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের স্বজনদের নির্বাচনে প্রার্থী না হতে নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই দলীয় সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন। এনিয়ে মাঠ পর্যায়ের তৃণমূল নেতাকর্মীরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এছাড়াও রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনের শুরু থেকেই চরম উত্তজনা দেখা দিয়েছে কাউনিয়া উপজেলা জুড়ে। এখানে বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম মায়া এবং উপজেলা যুবলীগের সভাপতি, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। একই ভাবে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদ নিয়ে কোন্দল তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখানে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন মঞ্জু। যেখানে তার প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জাফর আলীর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক মো. মনজুরুল ইসলাম রতন এবং কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন নয়ন। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ ও পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদ। মাহবুবুজ্জামান কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। অপরদিকে রাকিবুজ্জামান আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তারা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে কালীগঞ্জ উপজেলা জুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। স্থানীয়রা যে কোন মুর্হুতে সংর্ঘাতের আশংকা করছেন। এছাড়াও গত মঙ্গলবার হলফনামায় তথ্য গোপন করার অভিযোগে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ভাতিজা রাকিবুজ্জামান আহমেদের মনোনয়নপত্র বাতিলের দাবি জানিয়েছেন অপর প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। তিনি গত মঙ্গলবার লালমনিরহাট শহরের একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানান। ভোটাররা জানান, চাচা-ভাতিজা দুজন প্রার্থী হওয়ায় তারা কাকে ভোট দেবেন, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকে। বিপাকে পড়েছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও। তবে নির্বাচন পর্যন্ত ভোটারদের কাছে চাচা-ভাতিজার নির্বাচনী লড়াই বেশ উপভোগ্য হবে বলে জানান অনেকে। কালীগঞ্জ উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মাহবুজ্জামান আহমেদ বলেন, “আমি দুইবারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জয়ের ব্যাপারে আমি শত ভাগ আশাবাদী। এ ক্ষেত্রে আমার ভাতিজা তেমন কোনো সমস্যা নয় বা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।” এদিকে স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনের সংসদ-সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের ভাই ও ভাতিজাসহ তিনজন ডিমলা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এতে উপজেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। ডিমলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ-সদস্য আফতাব উদ্দিন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা না মানায় দলের নেতাকর্মী প্রশ্ন তুলছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে এমপি আফতাব উদ্দিন সরকারের দুজন নিকটাত্মীয় রয়েছেন। আনোয়ারুল হক সরকার মিন্টু তার আপন চাচাতো ভাই ও ফেরদৌস পারভেজ তার আপন ভাতিজা।মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের মধ্যে এমপির আপন ভাতিজি বউ রয়েছেন। তিনি হলেন-ডিমলা সদর ইউনিয়নের মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পারুল বেগম। এ ব্যাপারে সংসদ সদস্যের চাচাতো ভাই ডিমলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক সরকার মিন্টু বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের কোনো চিঠি এখনো হাতে পাইনি। তবে পত্রপত্রিকায় জানতে পেরেছি, মন্ত্রী-এমপির স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। দলীয় চিঠি হাতে পেলে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করব। অপর প্রার্থী সংসদ সদস্যের ভাতিজা ও উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহŸায়ক ফেরদৌস পারভেজ বলেন, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। এখানে চাচার (এমপি) কোনো প্রভাব নেই। এমপি আফতাব উদ্দিন সরকার বলেন, চাচাতো ভাই ও ভাতিজার প্রার্থী হওয়া নিয়ে শুরু থেকে বিরোধিতা করছেন। দলের সিদ্ধান্ত সবাই মানবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে রংপুর বিভাগের আরেক জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালার পুত্রবধূ প্রিয়া আগরওয়ালা। গত রোববার অনলাইনে মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন প্রিয়া আগরওয়ালা। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। তার স্বামী রাজীব পোদ্দার জেলা যুবলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। তার শাশুড়ি সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার মেয়ের জামাতা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সন্তোষ কুমার আগরওয়ালা। অন্যদিকে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের দুই চাচা, ভাই ও বোন ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলীর ছোট ছেলে উপজেলা যুবলীগের সদস্য আলী আফসার ও তার ফুফাতো বোন উপজেলা যুব মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদক সিমা আক্তার সুমনা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। মোহাম্মদ আলী ও সফিকুল ইসলাম বর্তমান সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের চাচা। আর আলী আফসার মাজহারুল ইসলামের চাচাতো ভাই এবং সিমা আক্তার সুমনা ফুফাতো বোন। এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য মাছহারুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠিন বার্তা দিয়েছেন। আমি প্রত্যেককে সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। নির্দেশ না মানলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।