রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৪ অপরাহ্ন
Reading Time: 2 minutes
শাহরিয়ার মিল্টন, শেরপুর :
সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে শেরপুরের গারো, হাজং ও কোচ উপজাতিদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকাজুড়ে কোচ, হাজং ও গারো উপজাতিরা বসবাস করছেন। ৩২৯ দশমিক ৫৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ১২টি ইউনিয়ন ও ১৩৮ টি গ্রামে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯৩৫ জন লোকের বসবাস। এ উপজেলায় রয়েছে ৪টি খ্রিষ্টান মিশন ও ৩ টি আদিবাসী কমিউনিটি সেন্টার ।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নে ৭৪ টি গ্রামে সহস্রাধিক কোচ ,হাজং ও গারো পরিবারের ৪০ হাজার উপজাতি লোকজন বসবাস করছেন। সীমান্তবর্তী পানিহাটা, তাড়ানি, পেকামাড়ি, মায়াঘাসি, নাকুগাঁও, দাওধারা, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বুরুঙ্গা, বাতকুচি, সমেশ্চুড়া, খলিসাকুড়ি, গাছগড়া ও নয়াবিল এলাকায় আদিকাল থেকে বাপ-দাদার বসত ভিটায় এসব উপজাতিরা বসবাস করছেন বলেই এরা নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করে আসছেন। চলমান বিশ্বের সব মানুষের জীবনমান বাড়লেও এখানকার উপজাতিদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। বরং তাদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব উপজাতিদের অন্যতম হলো গারো, হাজং ও কোচ। এসব স¤প্রদায়ের রয়েছে আলাদা কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং আলাদা সমাজ ব্যবস্থা। গারোরা খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী আর কোচ ও হাজং স¤প্রদায়ের লোকজন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। গারো উপজাতিদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত পরিবার। গারোদের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো বড়দিন। এছাড়াও প্রতিবছর ষ্টার সানডে, তীর্থ উৎসব, ইংরেজী নববর্ষ ও ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকেন। কোচদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপুজা ও কালিপুজা উৎসব। এসব ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও এ দুই স¤প্রদায় আরও অলাদা আলাদা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কালের বিবর্তনে বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসব গারো, হাজং ও কোচ উপজাতিদের শত শত বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী নেতা প্রদীপ জেংচাম বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে (আদিবাসীদের ভাষায়) মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, মিলাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাশি, আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী, রিক মাচুল আর কোচ আদিবাসীদের রাংঙ্গা লেফেন ও আছাম হারিয়ে যেতে বসেছে। আর খাদ্যের তালিকায় আছে বাঁশের কড়–ল (চারা বাঁশ) আর চালের গুড়া দিয়ে তৈরি খাবার উপকরন ‘মিয়া’, কলাপাতায় করে ছোট মাছ পুড়ে খাওয়া যার নাম ‘ইথিবা’, মুরগির বাচ্চা পুড়ে বাঁশের চোঙ্গায় ভরে পেয়াজ ও কাচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া যার নাম ব্রেংআ, মিমিল, কাকড়া, শামুক ও শুকরের মাংস, চালের তৈরি মদ যার নাম চু আর কোচ উপজাতিদের কাঠমুড়ি ইত্যাদি খাবার উপকরণ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। খলচান্দা গ্রামের পরিমল কোচ বলেন, আমরা বন-পাহাড়ে যুদ্ধ করে অসহায় জীবন যাপন করে আসছি। তাই পেটের তাগিদে ইতিহাস ঐতিহ্য বুঝিনা শুধু বুঝি বেঁচে থাকতে হবে। নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে ‘কোচভাষা’ আর গারোদের আছে ‘আচিক’ ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলাভাষার সংমিশ্রন হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা জুড়ে দিয়ে কথা বলে থাকে। খলচান্দা কোচপাড়া গ্রামের রমেশ চন্দ্র কোচ বলেন, আমাদের কোচ ভাষায় এখন বাংলা ভাষার মিশ্রন ঘটে গেছে। এমনকি তিনি নিজেও তাদের নিজস্ব ভাষার সাথে বাংলা ভাষা যোগ করা ছাড়া কথা বলতে পারেন না। নিজস্ব ভাষা সংরক্ষনের তথা মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য উপজাতিদের নিজস্ব ভাষায় স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবিও জানান খলচান্দা গ্রামের শিক্ষক পরিমল কোচ।
ট্রাইভাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডাব্লিউএ) চেয়ারম্যান মি.লুইস নেংমিনজা বলেন, বিলুপ্ত হচ্ছে বা হতে চলেছে এমন সব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষনে নালিতাবাড়ীতে আমরা আদিবাসী কালচারাল একাডেমি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। শেরপুর জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার বলেন, ‘পাহাড়ি উপজেলাগুলোতে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের ভাষায় পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করা সম্ভব হবে।’