বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৫ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর ব্যুরো :
রংপুরের ঐতিহ্যবাহি আম হাড়িভাঙ্গা।বসন্ত বাতাসে আম গাছে গাছে দোল খাচ্ছে হাঁড়িভাঙা আমের মুকুল। সদ্য মুকুল ফোটার এমন দৃশ্য এখন শুধু বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদেই নয়, নগরীর গাছে গাছেও সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আমের মুকুল। রংপুর নগরীসহ প্রায় সব উপজেলাতেই এখন প্রচুর আমবাগান রয়েছে। তবে বেশি বাগান রয়েছে মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ এলাকায়। এতে করে আম চাষিসহ মৌসুমী ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন বুনছেন। তারা লাভের আশা করছেন। চলতি মৌসুমে রংপুরে রংপুরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ২১৫ হেক্টরের বেশি জমিতে আম চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের তথ্য মতে, এর মধ্যে হাঁড়িভাঙার হয়েছে ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন হয় ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন। মুকুল আসার ৪ মাসের মধ্যে আম কৃষকের ঘরে ওঠে।
আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি সম্প্রাসারণ বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে হাঁড়িভাঙা দেশের গÐি পেরিয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হাঁড়িভাঙা আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে এবারও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। গত বছর গত বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার আম বিক্রি হয়েছে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে এবার ৫০০ কোটি টাকার আম বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যান্য জেলার আম যখন শেষ পর্যায়ে, তখনই হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসতে শুরু হয়। এই আম প্রায় দেড় মাস বাজারে পাওয়া যাবে।
এদিকে আম চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম বেশি দিন সংরক্ষণে রাখা যায় না। এই আম কীভাবে বেশি দিন সংরক্ষণে রাখা যাবে, এ নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। তাহলে এই আম বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। একই সঙ্গে রংপুরে একটি বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন ও বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করারও দাবি করেন। এতে বেশি উপকৃত হবেন আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলেও তারা জানান। জানা গেছে, ফল হিসেবে আম লাভজনক মৌসুমি ব্যবসা হওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে আমবাগানের সংখ্যা। ঘাম ঝড়ানো ধান-চালসহ অন্যান্য ফসলে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া চাষিদের হতাশার দিন শেষ হতে যাচ্ছে হাঁড়িভাঙা আমে। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় হাঁড়িভাঙা আম বদলে দিয়েছে মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জসহ রংপুরের চাষিদের জীবনমান। রংপুর সদরের পালিচড়া, বদরগঞ্জের শ্যামপুর, গোপালপুর, কুতুবপুর, নাগেরহাট, মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ, পদাগঞ্জ, রানীপুকুর, ময়েনপুর, ছড়ানসহ বিভিন্ন এলাকাসহ ও রংপুর নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে আমের বাগানের সংখ্যা বেড়েই চলছে । হাঁড়িভাঙা জাতের পাশাপাশি এখন আমরূপালী, বারি-৪ সহ বিভিন্ন জাতের আম চাষ হচ্ছে রংপুরে।
সরেজমিনে রংপুরের মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ, মিঠাপুকুরের আখিরাহাট, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর সদরের সদ্যপুস্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি, পালিচড়া এলাকায় দেখা মিলবে সারি সারি গাছ। রাস্তার দুইপাশে যেন হাঁড়িভাঙা আমগাছের সবুজ বিপ্লব। ধানসহ বিভিন্ন ফসলি জমির আইলে আইলে লাগানো হয়েছে আমের গাছ। বাদ পড়েনি বসতবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা, পুকুরপাড়, বাড়ির উঠান। এখন গাছে গাছে দোল খাচ্ছে মুকুল। একই এসব এলাকার আম বাগান মুকুলের মৌ-মৌ গন্ধে ভরে উঠেছে। পথচাচিরা মুগ্ধ নয়নে আম বাগানের দোলা খাওয়া মুকুল দেখে বিমোহিত হচ্ছেন। প্রকৃতি বৈরী না হলে এবারও সাধারণ আমের পাশাপাশি হাঁড়িভাঙা আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিক ও চাষিরা। মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ এলাকার আম চাষি আমজাদ হোসেন ও বদরগঞ্জে শ্যামপুরের শামসুজ্জামান, সাহেব আলীসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানান, বছরের এই আম বিক্রি করেই অনেক চাষি মেয়ের বিয়ে দেন, নিজের চিকিৎসা খরচ জোগাড় করেন, বড় ঋণ পরিশোধ করেন, মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে জমি ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। তাই গাছ, মুকুল আর আম অনেকেরই বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। তবে ফলন নিয়েও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেন।
সদরের পালিচড়া এলাকার চাষি নাজমুল ইসলাম ও সৌরভ মিয়া বলেন, ফেব্রæয়ারি মাসের আমের মুকুল এলে কৃষকরা আম বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঝড় কিংবা বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমের ফলন ভালো হবে। হাঁড়িভাঙ্গা আম এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে তারা দাবি করেন। এদিকে হাঁড়িভাঙা আম ঘিরে চাষিদের পাশাপাশি অনেক তরুণ-যুবকও স্বপ্ন বুনতে থাকে ভালো ব্যবসার। একারণে আমগাছে মুকুল এলেই দৌঁড়ঝাঁপ বাড়ে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর। ইতোমধ্যে বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদরের বিভিন্ন এলাকার আমবাগান বিক্রিও হয়ে গেছে। দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আগাম যোগাযোগ শুরু করেছেন আমচাষিদের সাথে।
এব্যাপারে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, রংপুর এখন হাঁড়িভাঙা আমের জন্য বিখ্যাত। এখন আমের গাছে গাছে মুকুল এসেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আমরা চাষিদের ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত প্রেসক্রিপশন দেওয়া হচ্ছে। এখন আবহাওয়া যদি রৌদ্রজ্জ্বল হয় এবং তাপমাত্রা একটু একটু করে বাড়ে তাহলে সমস্যা হবে না। সব মিলিয়ে প্রকৃতি বিরুপ না হলে, এবারও আমের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।