রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০২ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সাঁওতাল কৃষক মুকুল সরেনের (৩৫) বিষপানের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনা ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত কমিটি বলছে, তিনমাস আগে কৃষক মুকুল সরেনের স্ত্রী চলে গেছেন। সেই কষ্টে তিনি বিষপান করতে পারেন। তবে মুকুল বলছেন, তিনমাস নয়; স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে ছয় বছর আগে। বিষপানের কারণ তাঁর সাবেক স্ত্রী নয়। ধানের জমিতে পানি না পেয়েই তিনি বিষপান করেন।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, তদন্ত কমিটিকে তদন্তের জন্য সাত কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছিল। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিনেই সরেজমিনে গিয়ে নামকাওয়াসেবত তদন্ত করে কমিটি। তদন্তের সময় ভুক্তভোগী কৃষক মুকুল সরেনের কোন বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়নি। মুকুলের বাড়ি উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে। গত ৯ এপ্রিল দুপুরে বিষপান করলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন তিনি ছাড়পত্র পেয়ে বাড়িতে আছেন। জমিতে পানি না পেয়ে মুকুল বিষপান করেছেন এমন সংবাদ প্রকাশ হলে ১০ এপ্রিল রাতে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ তাকে হাসপাতালে দেখতে যান। তখন মুকুল তাকেও জানান যে, বোরো ধানে পানি না পেয়ে তিনি বিষপান করেন।
মুকুল বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ঈশ^রীপুর গভীর নলক‚পের আওতায় চাষাবাদ করেন। এই একই নলক‚প থেকে পানি না পেয়ে গত বছর বর্ষাপাড়ার পাশের নিমঘটু গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তারা সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি বিষপান করেন। এতে দুজনেরই মৃত্যু হয়। দুই কৃষকের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে তৎকালীন নলক‚প অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আর রবি ও অভিনাথের পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিনি কারাভোগ করেন।
একই নলক‚পে পানি না পেয়ে বিষপানের অভিযোগ উঠলে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ ঘটনা তদন্তে উপজেলা নির্কাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মহন্তকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করে দেন। কমিটির দুজন সদস্য হলেন- উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) সবুজ হাসান ও দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল।
তদন্ত কমিটির প্রধান সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, ‘সেচের পানির জন্য মুকুল বিষপান করেছেন এটা তদন্ত কমিটির কাছে মনে হয়নি। তিনমাস আগে তার স্ত্রী চলে গেছে। সেটা কারণ হতে পারে। এছাড়া গতবছর চাকরিচ্যুত হওয়া অপারেটরের ষড়যন্ত্র হতে পারে। তবে এটা আরও বেশি করে তদন্তের প্রয়োজন। আমরা গত বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’ পানির সংকট আড়াল করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন।
এদিকে শনিবার সকালে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ইনভেস্টিগেটর তাওহীদ আহমেদ রানা ও মোস্তফা কামাল ঢাকা থেকে আসেন বর্ষাপাড়া গ্রামে। তাদের সঙ্গে ছিলেন রাজশাহীর গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্য মাহমুদ জামাল কাদেরী এবং রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ। তারা মুকুলের বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। মুকুল তাদের জানান, ছয়বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। বিষপানের কারণ সাবেক স্ত্রী নয়। আটদিন ধরে গভীর নলক‚পের অপারেটর হাসেম আলী বাবু তাকে ঘোরাচ্ছিলেন। পানি না পেয়ে তিনি বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এখন বাবুকে বাঁচাতে অন্য গল্প সাজানো হচ্ছে। মুকুল বলেন, গভীর নলক‚পে কৃষকেরা নিজ নিজ প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে সেচ নেন। ক্রমিক অনুযায়ী কৃষকদের সেচ দেওয়ার কথা। কিন্তু অপারেটর বাবুর হাতে দু-একশো টাকা গুঁজে দিলেই আগেই পানি মেলে। তখন ক্রমিক অনুযায়ী পানি পান না সাধারণ কৃষকেরা। বিষপানের পর তার জমি দেখতে আসছেন অনেকে। তাই সব সময় পানি দিয়ে এখন জমিয়ে ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে। রাজশাহীর সুধি সমাজের প্রতিনিধি এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের পেয়ে পানি নিয়ে নিজেদের সমস্যার কথা জানালেন অন্য কৃষকেরা। ময়না বিশ^াস নামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক নারী এসে জানালেন, তাঁর স্বামী শীতল বিশ^াস পানির জন্য কয়েকদিন ধরে ঘুরছেন। কয়েকদিন আগে রাতে তার সিরিয়াল ছিল। কিন্তু অন্য একজন প্রভাবশালী এলে তাকে পানি দেওয়া হয়। শীতল বসেই থাকেন। রাগ করে শীতল গিয়ে নিজের জমির নালা কেটে ফেলেন। বলেন, তিনি আর পানি নেবেনই না। জমির ধান গাছ পুড়েই মরুক।
ময়না বিশ^াস সবাইকে নিয়ে নিজেদের দেড় বিঘা জমি দেখান। দেখা যায়, তাঁর জমি ফেটে চৌচির। তিনি যখন সবাইকে জমি দেখাচ্ছিলেন, তখনই তাঁর জমিতে সেচ দেওয়া শুরু করা হয়। আনোয়ার হোসেন নামের এক কৃষক এসে বললেন, লোকজন এলে পানি পাওয়া যায়। আর তা না হলে ঘুরতেই হয়। আনোয়ারেরও জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে বলে তিনি জানালেন। বিষপানের পর অপারেটর বাবু দাবি করেন, মুকুল সরেন গাঁজা সেবন করেন। সে বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ার বললেন, ‘তাকে একদিন সিগারেটও খেতে দেখিনি।’ মংলা সরেন নামের আরেক কৃষক জানালেন, মাসখানেক আগে সিরিয়াল অনুযায়ী পানি না দেওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। তাই অপারেটর বাবু তাকে মারতে উদ্যোত হন। তিনি বলেন, এর আগে পানির জন্য দুজন কৃষক বিষপান করে আত্মহত্যা করলেও সমস্যার সামাধান হয়নি।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলা শেষে গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এখানে সেচের পানি নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা। চাষিদের অভিযোগ যে, অপারেটর তার ইচ্ছেমতো পানি দেন। সমস্যা থাকলে সেটার সমাধান করতে হবে। কৃষক যদি পানি না পেয়ে বিষপান করেও তাহলে সেটা আড়াল করার কিছু নেই। সমস্যা মেনে নিয়েই আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সিরিয়াল লঙ্ঘন করে পানি দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অপারেটর হাসেম আলী বাবু তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। মুকুল পানির জন্য বিষ খায়নি।’জানতে চাইলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ওই গ্রামে পানির সমস্যা নেই। অপারেটরের সঙ্গে কৃষকদের অভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা থাকতে পারে। কী সমস্যা তা জানতে আমরা তিন সদস্যের একটা কমিটি করে দিয়েছি। আগামী রোববার রিপোর্ট পেতে পারি। দেখে যদি মনে হয়, অপারেটরের দোষ, তাহলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘ওই এলাকার কৃষকদের এবং অপারেটরকে মোটিভেশন করতে হবে। কৃষকরা সমস্যায় পড়লে বিষ না খেয়ে যেন আমাদের ফোন করে। এ জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং করতে হবে। ইউএনওকে এ রকম মিটিং আয়োজনের কথা বলেছি।’রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, ইউএনওকে প্রধান করে তিনি যে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলেন সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন এখনও দেখেননি। বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন এসে থাকলে রোববার তিনি দেখবেন। তিনি বলেন, ‘পানির জন্য কাউকে বিষপান করতে হবে না। সবাই যেন সুশৃঙ্খলভাবে পানি পায়, এটি জেলা প্রশাসন নিশ্চিত করবে বলেও জানান তিনি।