শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:১৭ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর ব্যুরো॥
যমুনা ও পদ্মার পর এবার দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ নদ ব্রহ্মপুত্রে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন প্রভাব নিরূপণ নিয়ে সম্প্রতি স্থানীয় পর্যায়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ব্রহ্মপুত্রের ওপর সেতু নির্মিত হলে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। এই সেতু শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া যমুনা নদীর ওপর নির্মিত একমাত্র সেতু বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপও কমবে। এই সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ তৈরি হলে তা ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের সর্বোত্তরের জেলাগুলোকে রেলপথেও সরাসরি যুক্ত করবে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চিলমারী থেকে রৌমারী করিডোরে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন প্রভাব নিরূপণসংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রৌমারী উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত ১২ সেপ্টেম্বর দিনব্যাপী সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। অন্যদের মধ্যে ছিলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াসিম আলী, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, টিপসা প্রতিনিধি কার্লোস পেরেজ মানানেট, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. সুদেশ কাউল ও পরিবেশবিদ ড. সমর কুমার ব্যানার্জী।
সভায় আলোচকরা বলেন, এ সেতু হলে কুড়িগ্রাম সোনাহাট স্থলবন্দর, চিলমারী নৌবন্দর, নীলফামারীর চিলাহাটি বন্দর, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা বন্দর, লালমনিরহাটের বুড়িমারী বন্দর এবং দিনাজপুরের হিলি বন্দরের সঙ্গে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা আমূল পাল্টে যাবে। ব্রহ্মপুত্র সেতু হলে উত্তরবঙ্গের রংপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলার সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কমে আসবে। এই সেতু দিয়ে গ্যাস সংযোগ তৈরি করা গেলে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রামে কল-কারখানার পাশাপাশি বাড়বে ব্যবসার পরিধি।
আলোচকরা আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু হলে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এই সেতুর গুরুত্ব বাড়বে। কেননা ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্যসহ নেপাল এবং ভুটানের টানজিট রুট হিসেবে এটিকে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল করতে ব্রহ্মপুত্র সেতু অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে।
চিলমারী উপজেলার বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু হামার খুব দরকার। এই সেতু হলে হামার নদী ভাঙন রোধ হবে। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করবার আসবে। হামার কাজের সুযোগ তৈরি হবে।’
শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হামার অভাবী এলাকা। সারা বছর কাজ থাকে না। তাই জেলার বাইরে কাজ করার জন্য যেতে হয়। বর্তমানে ঢাকা, সিলেট যেতে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা খরচ আর সময় নাগে ১৪ থেকে ২০ ঘণ্টা। ব্রহ্মপুত্র সেতু হলে এই এলাকার ভাগ্য ঘুরে যাবে।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু না থাকায় কুড়িগ্রাম-রংপুর-বগুড়া হয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে যেতে ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা ব্যয় হয়। অন্যদিকে রৌমারী-শেরপুর-জামালপুর দিয়ে ঢাকা-সিলেট-ময়মনসিংহ যেতে ৫ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সেতু বাস্তবায়ন হলে সময় এবং অর্থনৈতিকভাবে সবাই লাভবান হবে।’
রৌমারী উপজেলার বাসিন্দা মোজ্জাম্মেল হক বলেন, ‘জেলার সঙ্গে রৌমারী-রাজিবপুর ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা আলাদা। এখানে কেউ অসুস্থ হলে নৌকা ভাড়া করে রোগী নিয়ে যেতে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর অফিস-আদালতে কাজের জন্য গেলে সিরিয়ালের নৌকা না পেলে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। এক দিন আগে গিয়ে কুড়িগ্রামে থেকে পরের দিন কাজ শেষ করে ফিরতে হয়। হামার এখান থেকে ঢাকা যাওয়া সহজ। কিন্তু কুড়িগ্রাম যাওয়া কঠিন।’
শিক্ষার্থী নাজিম উদ্দিন ও আলম মিয়া, রিপন মিয়া বলেন, ‘জেলার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকায় অভাবী এলাকার অনেক ভালো শিক্ষার্থীদের মেসে থেকে পড়াশোনার সামর্থ্য থাকে না। ব্রহ্মপুত্র সেতু হলে দিনে গিয়ে দিনেই আসা সম্ভব।’
গত বছরের নভেম্বর মাসে সেতু কর্তৃপক্ষ গঠিত একটি টিমের অংশ হিসেবে অতিরিক্ত সচিব ও পরিচালক ড. মনিরুজ্জামান (পিএনডি), সেতু কর্তৃপক্ষের সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী, সেতু বিভাগের সদস্য ও উপসচিব (বাজেট) আবুল হাসান ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন।
পরিদর্শনে ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, রৌমারী উপজেলার বলদমারা থেকে চিলমারী উপজেলার ফকিরের হাট পয়েন্টের দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। চররাজিবপুর উপজেলা থেকে চিলামারীর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে বলদমারা থেকে ফকিরের হাট অ্যালাইমেন্টে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার আয়তনের ২০০ বিঘার চর এবং আড়াই কিলোমিটার আয়তনের বাঘুয়ার বাঁশদহের চর প্রায় ৩০ বছর পূর্বে গঠিত হয়। পানির লেভেল থেকে ৮-১০ ফুট ওপর চর দুটি অবস্থিত। এখানে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার অংশ ভায়াডাক্ট এবং ৪ দশমিক ২০ কিলোমিটার জলভাগের অংশে ক্যাবল স্ট্রেইট সেতু নির্মাণের জন্য সাশ্রয়ী ও যুক্তিযুক্ত।
অতিরিক্ত সচিব ও পরিচালক ড. মনিরুজ্জামান (পিএনডি) ব্রহ্মপুত্র সেতুকে সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে বলেন, ‘এই এলাকায় সেতুটি নির্মাণ করা গেলে মানুষের উন্নয়ন হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা এটা দেখেছি এবং আমাদের মতামত কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরব।’
এই বিষয়ে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে জীবন মানের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণ অসম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামবাসীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্রহ্মপুত্র সেতু নির্মাণ জরুরি।’