রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
@ নিরচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় ব্যবহ চাষাবাদ
@ সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি
হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর:
রংপুর নগরীসহ এ অঞ্চলে গত বছরের তুলনায় এ বছর বোরো ধান চাষে কৃষকদের অতিরিক্ত খরচ গুনতে হবে প্রায় ১৭২ কোটি টাকা। ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় শুধু সেচেই খরচ বাড়বে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়াও সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় প্রতি বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনে বাড়তি খরচ হবে সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
জানা গেছে, দেশের মানুষের চালের ৬০ ভাগ জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে। আর এই চালের জোগানের প্রায় অর্ধেকের বেশি যায় রংপুরসহ এ অঞ্চল থেকে। তবে গত বছরের মাঝামাঝিতে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আর এ বছরের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে বোরো উৎপাদনে খরচ বাড়ছে কৃষকের। কৃষকরা বলছেন, গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা। শীত মৌসুমে যখন চাষাবাদে ব্যস্ত কৃষক, তখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে রংপুর নগরী সহ আশপাশের জেলাগুলোতে। ঠিক মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় চাষাবাদসহ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিড়ম্বনায় বলে তারা জানান।
তাদের অভিযোগ, গত কয়েক দিন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং অব্যাহত রয়েছে। হঠাৎ কেন এমন বিদ্যুৎ বিপর্যয়- এ প্রশ্নের জবাব নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহসাই মিলছে না। তবে কর্মচারীরা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণেই ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে দাবি তাদের। এদিকে কৃষকরা জানান, গত বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে সেচের খরচ ছিল ১২০০ টাকা, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০০ টাকায়। বীজ প্রতি কেজি ছিল ২০০ টাকা, এবার তা হয়েছে ৩৫০ টাকা। এ ছাড়াও জমি তৈরি ৯০০ থেকে ১৩০০ টাকা, সার খরচ ২০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা, কীটনাশক ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা, ধান রোপণ ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ধান কাটা-মাড়াই ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকা হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হবে জমির ভাড়া ৫০০০ টাকা। সে হিসেবে গত মৌসুমে এক বিঘা জমিতে বোরো উৎপাদনের খরচ ছিল ১৪ হাজার ৯০০ টাকা। আর এ বছর তা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৪৫০ টাকায়। অর্থাৎ বিঘায় খরচ বাড়ছে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা। চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর সেচ পাম্প ৬২ হাজার ৭৫৩টি, অগভীর ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৪টি, ডিজেলচালিত গভীর ৩৩২টি এবং অগভীর সেচ পাম্প রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজার ১৮টি। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় সেচে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুৎচালিত গভীর-অগভীর সেচ পাম্পের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫২৭টি এবং ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩০টি। শুধু সেচেই কৃষকের ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। নগরীর তামপাট এলাকার কৃষক নুর ইসলাম ও আশরাফুল আলম বলেন, সার, বীজ, কীটনাশকের দামও চড়া। শীতকালে শ্রমিক সংকটও রয়েছে। যদি শ্রমিক পাওয়া যায়, তবে মজুরি বেশি। গত বছর ডিজেলের দাম বেড়েছিল। এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এখন উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। এভাবেই যদি দাম বাড়তেই থাকে তাহলে কৃষকরা অতিরিক্ত ব্যয় সামাল দিতে মাঠে মারা পড়বে। সাহেবগঞ্জ তকেয়া গ্রামের মাহমুদুল ইসলাম মানিক নামের এক কৃষক বলেন, বোরোর জমি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে। তবে এবার ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচ খরচে বাড়তি খরচ হবে। এতেই বাড়বে উৎপাদন ব্যয়। গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘন্টার কৃষক আব্দুল মতিন ও খলেয়ার রিয়াজুল মানিক বলেন, বর্তমানে চাষাবাদ করা মুশকিল। কারণ সব কিছুতেই দাম বেড়েছে। সরকারের উচিত ছিল কৃষি এবং কৃষকের কথা চিন্তা করে ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা। কিন্তু কেউ তো তা করছে না। এভাবে চললে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বোরে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রোপণ হয়েছে সড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, বোরো চাষে অতিরিক্ত সেচ লাগে। সেচ দিতে যেন পানির অপচয় না হয় সেজন্য আমরা কৃষকদের লক্ষ্য রাখতে বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের সুষম সারের ব্যবহারে উৎপাদন যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্যও কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খরচ কমাতে কৃষকদের পরিমিত সেচ এবং নিয়ম মেনে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এব্যাপারে কৃষক সংগঠক আনোয়ার হোসেন বাবলু ও কৃষক নেতা শাহ নেওয়াজ লাবু বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে প্রান্তিক, বর্গা আর গরিব কৃষকরা প্রধান। তাদের হাতে কিন্তু টাকা-পয়সা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের উচিত সরাসরি মাঠে গিয়ে তাদের একটি তালিকা করে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। তারা যেন সেই প্রণোদনা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব হলে উৎপাদনের ধারাটা সচল রাখা সম্ভব হবে বলেও তারা জানান।