সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:
রাজশাহীর দূর্গাপুরের আঙ্করার বিলে কয়েক বছর আগেও বছরে দুইবার শুধু ধান চাষ হত। কোনো জমিতে একবারও হত। বিলের উঁচু ভিটাতে হত সবজি চাষ। কিন্তু এখন বিলের যেদিকে চোখ যায়, সেইদিকে পুকুর আর পুকুর। গত কয়েক বছরে স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে প্রায় শতাধিক পুকুর খনন করে হচ্ছে মাছ চাষ। বিলিন হয়ে গেছে আঙ্করার বিল। এখন এইসব পুকুরগুলোতে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, সিলভার, ব্লাডকার্প, গ্লাস কার্প, ট্যাংরা, পাবদাসহ নানা জাতের মাছ।
অধিকাংশ পুকুর মালিক জমি বর্গা (স্থানীয় ভাষায় লিজ বলা হয়) ৮-১০ বছরের জন্য নিয়ে মাছ চাষ করছেন। এসব পুকুর থেকে তাজা রফতানি মাছ হচ্ছে ঢাকা, সিলেট, নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আর তাতে কৃষি জমি হারালেও মাছ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে পুকুরের জন্য জমি বন্ধক দিয়ে ধান চাষের চেয়ে বাড়তি টাকা বসে থেকে পকেটে পুরছেন জমির মালিকরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দূর্গাপুরের এই আঙ্করার বিলেই নয়, উপজেলার উজান খলিস, খুগিশো, পালশা, রাতুগ্রাম, পুরান তাহেরপুর, কয়ামাজমপুর, গোপালপুর, শ্যামপুর, তেঘোর, আমগাছী, চৌপুখরিয়াসহ অধিকাংশ বিলেই গত ৫-১০ বছরের মধ্যে এক বা তিন ফসলি জমি কেটে হাজার হাজার পুকুর গড়ে তোলা হয়েছে। আবার শুধু দূর্গাপুরেই নয়, জেলার বাগমারা, মোহনপুর, পবা, তানোর, গোদাগাড়ী, বাঘা-চারঘাট এবং পুঠিয়ার বিভিন্ন বিলেও গড়ে উঠেছে হাজার হাজার পুকুর।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র মতে, বর্তমানে রাজশাহীর নয়টি উপজেলাতে মোট পুকুরের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭২০টি। যা গত ১০ বছর আগে ছিলো সর্বোচ্চ ২০ হাজারটি। ফলে এই ১০ বছরে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩০ হাজার পুকুর। আর এসব স্থানে এক বা তিন ফসলি জমি ছিলো। বর্তমানে এসব ফসলি জমি কেটে এসব পুকুরই গড়ে উঠেছে। এমনকি আমের বাগান, বা ফসলের ভিটা কেটেও গড়ে উঠেছে পুকুর।
মৎস্য কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, জেলায় এখন মোট ১১৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পুকুর রয়েছে। যেখান থেকে বছরে ৮৩ হাজার ৪৯২ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। যার মধ্যে রাজশাহীতে চাহিদা রয়েছে ৫২ হাজার ৫৬৩ মেট্রিক টন। বাকিগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে চাষিরা বলছেন, রাজশাহীতে এখন যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হচ্ছে, তার সিংহভাগই ট্রাকে করে চলে যাচ্ছে ঢাকা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর এখান থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৬৯ কোটি টাকা আয় হচ্ছে। তাতে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। অন্যদিকে জমি বর্গা দিয়ে বসে থেকে বছর শেষে বিঘা প্রতি ১০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন জমির মালিকরা। যেসব জমি এখন থেকে ৫-৮ বছর আগে বর্গা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর টাকা কম করে পান মালিকরা। কিন্তু গত তিন-চার বছর ধরে যেসব জমি বর্গা হচ্ছে সেগুলোতে উচ্চ হারে টাকা পাচ্ছেন মালিকরা। সে ক্ষেত্রে বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাচ্ছেন পুকুর মালিকরা।
দূর্গাপুরের মাছচাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তেমন লাভ হচ্ছে না। তার পরেও লোকসান হচ্ছে না। কিন্তু ফসল চাষ করতে গেলে একবার লাভ হয় তো তিন চার বছর লোকসান গুনতে হয়। ধানের যে উৎপাদন খরচ হয়, সেটিও অনেক সময় ওঠে না। ফলে জমি বর্গা দিয়ে এখন কৃষকরা তার চেয়ে ২-৪ গুন পরিমাণ ধান বা চাল কিনতে পারেন। যা জমিতে করে সম্ভব হয় না। এ কারণে দিনের পর দিন ফসলি জমি খনন করে পুকুর হচ্ছে। বাড়ছে পুকুরের সংখ্যা। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুকুরে শুধু মাছ চাষই নয়, পাড়ে চাষ হচ্ছে আম, কলা, পেয়ারা, পেঁপে, লেবুসহ নানা ধরনের সবজিও। ফলে এসব থেকেও আসছে অর্থ। কেবল মাছ চাষ করেই কোটিপতি বনে গেছেন এমন চাষির সংখ্যাও বাড়ছে দিনের পর। আয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। তবে কেবল মাছ চাষ করেই রাজশাহীতে কোটিপতি বনে গেছেন অনেকেই। অনেক বেকার যুবকও হয়েছেন সাবলম্বি বা লাখোপতি। যেটিকে পজেটিভ দিক হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে। ফলে পুকুর কাটতে নানা নিয়ম-নীতি থাকলেও সেভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে না।
দূর্গাপুরের গগনবাড়িয়া গ্রামের কৃষক নাদের আলী জানান, এসব পুকুর কাটার সময় স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে থানা পুলিশ এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করার জন্য লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য হওয়ার খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। অবাধে পুকুর কাটা রোধে উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। পুকুর কাটা রোধে স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জেল-জরিমনাও করেছেন। এমনকি দূর্গাপুরের জয়নগর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজুল করিমকেও জেলে দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমান আদালত। এতোকিছুর পরেও বন্ধ করা যায়নি পুকুর কাটা। বর্ষা শেষেই প্রতি বছর পুকুর কাটার প্রতিযোগীতায় নেমে পড়েন একটি শ্রেণির সুবিধাভোগী মানুষ।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল বলেন, জেলায় গত কয়েক বছরে পুকুরের কারণে অনেক ধানি জমি কমেছে। তবে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরেও পুকুরগুলো কিভাবে গড়ে উঠেছে সেটি বলতে পারব না। জেলায় গত কয়েক বছরে মোট কী পরিমাণ ফসলি জমি পুকুরের কারণে নষ্ট হয়েছে সেটিও বলতে পারব না।
অপরদিকে, রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলোক কুমার সাহা বলেন, ‘গত কয়েক বছরে রাজশাহীতে প্রায় দ্বিগুন হারে মাছের উৎপাদন উৎপাদন বেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে পুকুরও বেড়েছে দুই-তিন গুন। মাছ চাষ করে অনেক বেকার যুবক সাবলম্বি হচ্ছেন। মাছ চাষের জন্য চাষিদের নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে জেলার উৎপাদিত মাছ এখন দেশ ও দেশের বাইরে রপ্তানী করে বিপুল অর্থ আয় হচ্ছে বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।