রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:
রাজশাহীর স্বাধীনের বছরে ৩১ মণ মধু উৎপাদন করে থাকেন। যা থেকে বছরে তার আয় ৭ লাখ টাকা। মাত্র ৩৫টি মৌমাছির বক্স থেকে বছরে প্রায় ৩১ মণ মধু উৎপাদন করেন তিনি। স্বাধীনের কাছে সরিষা ও লিচুর মধু পাওয়া যায় বছরজুড়ে। রাজশাহীর পবা উপজেলার দারুশার কইকুঁড়ি এলাকার রেজাউল করিম স্বাধীন দীর্ঘ ২২ বছর ধরে একাধারে মৌমাছি চাষ ও মধু বিক্রি করছেন। তার দাবি খাঁটি মধু হওয়ায় বিক্রি বেশি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার মধুর গ্রাহক রয়েছে। অনলাইনের মাধ্যমে মধু বেশি বিক্রি হয়ে থাকে তার। জানা যায়, ৬০০ টাকা কেজি দরে এই মধু বিক্রি করে বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা আয় করেন স্বাধীন। সরিষা বিলে মৌমাছির ৩৫টি বক্স বসিয়েছেন তিনি। এখানে নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি বক্স থেকে সপ্তাহে ৫ কেজি করে মধু পান তিনি। তাতে মাসে ১৭৫ কেজি মধু উৎপাদন হয় বক্সগুলো থেকে। প্রতি বছর শুধু সরিষা থেকে ২২ মণ ও লিচু থেকে ৯ মণের বেশি মধু উৎপাদন হয়। তবে লিচুর মধু মুকুলের ওপরে নির্ভর করে। তার গোদাড়ীর শতলাই বাজারে নাতিয়া মৌ-চাষ প্রকল্প নামের মুধ বিক্রির দোকান রয়েছে।স্বাধীন জানান, ১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তখন রাজশাহীতে থাকতেন। একদিন টেলিভিশনে দেখেন কৃষির সঙ্গে মধু চাষ। তখন থেকে ভেবেছিলেন মৌমাছি দিয়ে মধু চাষ করবেন। সেখান থেকে আইডিয়া আসে তার। তারও কিছু বছর পরে তিনি মধু চাষ শুরু করেন। কইকুঁড়িতে সরিষা বিলে তিন ধরনের মৌমাছি আছে। কাঠের বক্সে মৌমাছিগুলো থাকে। তাদের মধ্যে পুরো বক্স জুড়ে একটা রানি মৌমাছি বা উর্বর মৌমাছি থাকে। একটা পুরুষ বা ড্রোন মৌমাছি ও বাকিগুলো কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছি। বন্ধ্যা মৌমাছিগুলো ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বক্সে আসে। আর মধু উৎপাদনের মূল কাজটি করে থাকে রানি মৌমাছি। স্বাধীন বলেন, আমাদের দেশে চার ধরনের মৌমাছি থেকে মধু পাওয়া যায়। ডরডাশা, মেলি ফেরা, সেরেনা ও ফ্লুরিয়া মৌমাছি। সবচেয়ে বেশি মধু হয় ডরডাশা মৌমাছি থেকে। এই মৌমাছির রাগ বেশি। তারা মানুষকে কামড় দেয়। রাগ বেশে হওয়ায় বিশ্বের কোনো দেশ এই মৌমাছিকে চাষ পদ্ধতিতে নিয়ে আসতে পারেনি। মেলি ফেরা শান্তি প্রকৃতির মৌমাছি। এটা চাষ পদ্ধিতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। আর এপিস সেরেনা মৌমাছি মাটির মধ্যে গর্ত করে থাকে। সেখানে মধু কম হয়। পরিবারের জন্য চলবে। তবে ব্যবসা করা যাবে না। ফ্লুরিয়া মৌমাছি আমাদের দেশি। তাতেও মধু কম হয়। স্বাধীন প্রথম অবস্থায় দেশি প্রজাতির ফ্লুরিয়া মৌমাছি দিয়ে চাষ শুরু করেন। তবে তখন তেমন মধু উৎপাদন হতো না। ১৫ বছর আগে ইউরোপিয়ান ‘মেলি ফেরা’ জাতের মৌমাছি চাষ শুরু করেন তিনি। এই মৌমাছি প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে সংগ্রহ করেছিলেন গোদাগাড়ীর বিদিরপুরের সুনিল নামের এক ব্যক্তি। সুনিলের আত্মীয় ভারতে থাকেন। তার আত্মীয় সুনিলকে মধু চাষের জন্য কিছু ইউরোপিয়ান ‘মেলি ফেরা’ জাতের মৌমাছি দিয়েছিলেন। সুনিল স্বাধীনের কাছে এই মৌমাছিগুলো বক্সসহ বিক্রি করে দেন। তারপর থেকেই স্বাধীনকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি।তিনি আরও বলেন, রানি ছাড়া অন্য মৌমাছি (বন্ধ্যা) মাত্র ৪৫ দিন বাঁচে। তবে ডিম দেওয়া রাণী মৌমাছি বাঁচে সাড়ে ৩ থেকে ৪ বছর। এ সময় রানি মৌমাছি এক নাগাড়ে ডিম দেয় প্রায় আড়াই বছর। বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেশি ডিম দেয় রানি। একটি রানি মৌমাছি প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১২০০টি ডিম দেয়। রানি মৌমাছি তিন প্রকারের ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে রানি বা উর্বর মৌমাছি, ড্রোন বা পুরুষ ও কর্মী মৌমাছি বা বন্ধ্যা মৌমাছির জন্ম হয়। যখন রানির বয়স হয়ে আসবে তখন নিজেই রানি মৌমাছির ডিম দেয়। একইভাবে দেখা শোনার জন্য পুরুষ বা ড্রোন মৌমাছির ডিম দেয় রানি মৌমাছি। একটা বক্সে ৯ থেকে ১০টি ফ্রেম থাকে। ফ্রেমের দুই পাশেই বসে মৌমাছি। ৩৫টি বক্সেই একটি করে রানি মৌমাছি রয়েছে। এই মৌমাছি রানির সঙ্গে পুরুষের বছরে একবার মিলন হয়। মিলনের পরে পুরুষ মৌমাছি মারা যায়। এরপরে রানি মৌমাছি সারাবছর ডিম দেয়।মৌমাছির মারা যাওয়া ও খাবারের বিষয়ে তিনি বলেন, মৌমাছি পাঁচ মাস বিভিন্ন ফুল থেকে খাবার সংগ্রহ করে খায়। আর বছরের সাত মাস তাদের চিনি পানিতে গুলে খেতে দিতে হয় ঘরের ভেতরে। তবে বর্তমানে ক্ষেতে কিটনাশক দেওয়ায় সেই বিষ খেয়ে মৌমাছিও মারা যায়। এখন সরিষা মধুর সময়। অনেক চাষি নিজেদের সরিষার ভালো ফলন ও চাষের জন্য বিষ প্রয়োগ করে থাকে। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহে গিয়ে বিষ খেয়ে নেয়। এরপরে মাতালের মতো উড়তে উড়তে এসে বক্সের কাছে মরে পড়ে থাকে। সরিষায় বিষ দেওয়ার কারণে এই বছর ৫টি বক্সের মৌমাছি মারা গেছে। এ বিষয়ে পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামসুন নাহার জানান, সাধারণত সরিষায় কোনো কিটনাশকের (বিষ) প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। তারপরেও কৃষকরা প্রয়োগ করে। আমরা তাদের বার বার বলেছি বিষ প্রয়োগ করলে বিকেলের পরে। তাহলে মৌমাছিগুলো মধু নিতে গিয়ে বিষ খেয়ে মারা পরবে না।
সরিষা ও মধু চাষের বিষয়ে স্বাধীন জানান, এক সময় মানুষের মধ্যে ধারণা ছিল সরিষার জমি পাশে মৌমাছির মধু উৎপাদনের বক্স থাকলে সরিষার ফলন কম হয়। কিন্তু এখন মানুষের সেই ধারণা পাল্টে গেছে। তারা বুঝতে পেরেছে সরিষার জমিতে যত মৌমাছি যাওয়া-আসা করবে তত পরাগায়ন ঘটবে। তাতে করে সরিষার ফুল ও ফল ভালো হবে। এখন অনেকেই বলে নিজেদের জমির পাশে মধুর বক্স বসাতে। একইভাবে লিচু, কালোজিরা, ধনিয়াতে মৌমাছির পরাগায়ন ঘটলে ফলন ভালো হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন জানান, রাজশাহী জেলায় এ বছর ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর বেশি জমিতে চাষ হয়েছে। গেল বছর ছিল ২৬ হাজার ১৫৬ হেক্টর। সেই হিসেবে রাজশাহী জেলায় এবছর ১৬ হাজার ৩৯৪ হেক্টর বেশি জমিতে কৃষকরা সরিষার চাষ করেছে। তবে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় এ বছর সরিষার চাষ বেড়েছে। সেই জায়গা থেকে সরিষা চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের মধ্যে। গত বছরের মতোই প্রণোদনা ছিল। তবে চাষিরা বেশি সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন। নতুন নতুন উন্নত জাতের উদ্ভাবনের ফলে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে।