রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১০ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
শাহরিয়ার মিল্টন,শেরপুর :
সীমান্তবর্তী শেরপুর পাহাড়ি এলাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি। পাহাড়ে বসবাসরত হাজং, বানাই ও ডালুসহ ৪টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আর গারো, কোচ ভাষা কোনোমতে পরিবার পর্যন্ত টিকে আছে। নিজের ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা বই থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অভাবে সেগুলো পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। ফলে তারা আধো আধো ভাষায় কথা বলতে পারলেও ওই ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারছে না। জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এ পাহাড়ি এলাকাসহ পুরো জেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালুসহ সাতটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এসব গোষ্ঠীর মানুষের আছে আলাদা আলাদা ভাষা, আছে নিজস্ব সংস্কৃতিও। নিজ ভাষায় কথা বলাসহ সামনে এগোতে চান তারা। কিন্তু চর্চা আর সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে তাদের মাতৃভাষা। পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্প মাতৃভাষায় করলেও এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হয় বাংলা ভাষার হাত ধরেই। তাই দিন দিন তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ ফুটে উঠেছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিযোগ, তাদের ভাষার চর্চা না থাকায় এখন বাংলা ভাষার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। জানা যায়, ভারত সীমান্তঘেঁষা বানাইপাড়ায় বেশ কয়েকটি বানাই পরিবার বাস করলেও প্রায় হারিয়েই গেছে ডালু জাতিগোষ্ঠী। ভাষার সঙ্গে হুমকির মধ্যে তাদের সংস্কৃতিও। ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপ না থাকায় হারাতে বসেছে এ দুটি জাতিগোষ্ঠীসহ ৪টির ভাষা ও সংস্কৃতি। সরকার কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভাষায় বই দিলেও তা পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। তাই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিদ্যালয়ে নিজ ধর্মের শিক্ষক চায় ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে। সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। তবে এসব ভাষার বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বইগুলো শিশুদের আদতে কোনো কাজেই আসছে না। শিক্ষার্থী অনুসৎ হাজং বলেন, ‘আমরা স্কুলে খালি বাংলা ও ইংরেজি পড়ি। তাই আমরা বাড়িতে গিয়েও বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাগো ভাষা বলবার পাই না।’ শিক্ষার্থী সুব্রত বর্মণ বলেন, ‘আমাদের স্কুলে তো আমাদের ভাষায় পড়ায় না। খালি বাংলা ভাষা পড়ায়। তাই আমরা আমাদের মায়ের ভাষা বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না।’
প্রলয় হাজং বলেন, ‘আমাদের আগের লোকজনরা হাজং ভাষায় কথা বলতে পারলেও আমরা এখন পারি না। কারণ স্কুলে আমরা তো বাংলা ভাষা শিখে বড় হয়েছি। আমরা চাই সরকার স্কুলগুলোতে আমাদের ভাষায় শিক্ষাদান চালু করুক।’ সুকেন্দ্র চন্দ্র ডালু বলেন, ‘আমাদের ডালু গোষ্ঠী তো এখন হারিয়ে গেছে। আমরা কয়েকটা পরিবার আছি, কিন্তু ভাষাও হারিয়ে গেছে। কেউ এহন ডালু ভাষা পারি না।’ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আদিবাসী নেতা প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, আমাদের ভাষার বই সরকার দিলেও তা পাঠদানের জন্য কোনো শিক্ষক দেয়নি। আমরা চাই আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনাই হলো, কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারবে, শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে।
সামাজিক সংগঠন জন-উদ্যোগের আহŸায়ক শিক্ষাবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার। যেকোনো মূল্যে সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বনকুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিরণ চন্দ্র বর্মন বলেন, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আদিবাসী অভিভাবকরাও বাড়িতে তাদের মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণে। আবার অনেকেই সমাজে তাদের ভাষা প্রয়োগের বিষয়ে লজ্জাবোধ করে থাকেন। ঝিনাইগাতী উপজেলার সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী কেয়া নকরেক বলেন, প্রত্যেক দেশের আলাদা আলাদা ভাষা থাকে থাকে আলাদা বৈচিত্র এই বৈচিত্র টিকিয়ে না রাখলে আমাদের ঐতিহ্য বিলুপ্ত হবে। তাই ভাষার মাসে আমাদের গারো পাহাড়ের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ভাষা সংরক্ষণে সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি জানাই।
শেরপুর আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কো-অর্ডিনেটর তাপস বিশ্বাস বলেন, শেরপুর অঞ্চলের সাতটি নৃ-গোষ্ঠী স¤প্রদায়ের মধ্যে চারটির ভাষা হারিয়ে গেছে। কেবলমাত্র গারো, কোচ ও হাজং’র ভাষা কোনো রকমে টিকে আছে। আমাদের হদি ভাষাটি ভারতের কিছু অঞ্চলের বোরো বা কাচারি ভাষা নামে পরিচিতি রয়েছে। আমি চেষ্টা চালাচ্ছি ওই ভাষার বর্ণমালা উদ্ধারের জন্য। তবে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। শেরপুর আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প (আইইডি) ফেলো সুমন্ত বর্মন বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আদিবাসী শিশুরা তাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করতে উৎসাহ বোধ করে না। আদিবাসী বিভিন্ন সংগঠন থেকে বিভিন্ন ভাষার হরফ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। শেরপুরে আদিবাসীদের ভাষার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে একটি কালচারাল একাডেমি খুব জরুরি।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলায় সাতটি নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬শ’ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ১ হাজার। এছাড়াও বিভিন্ন কিন্ডার গার্ডেনে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, সরকারিভাবে গত দুই বছর যাবৎ গারো ভাষার প্রাক-প্রাথমিকসহ তিনটি শ্রেণীর তাদের নিজস্ব বর্ণমালার বই পাওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধি সেসব বই শেরপুরে পৌঁছায়নি। তবে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য বইয়ের চাহিদার তথ্য পাঠানো হয়েছে। খুব শীঘ্রই তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।