সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৫ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 6 minutes
১৯৫৭ সালের জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলের দু’দিন ব্যাপী সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। সম্মেলনের নাম ছিল “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন। আহবায়ক ছিলেন নিপীড়িত জনগণের তৎকালীন অবিসংবাদিত নেতা জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী । তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী তখন আওয়ামীলীগ নেতা (পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সভাপতি) হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়াদী। কেন্দ্রে যেমন অধিষ্ঠিত ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার-তেমনই পূর্ব পাকিস্তানের অধিষ্ঠিত ছিল আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা-যার অংশীদার ছিল মনোরঞ্জন ধরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেস, হাজী দানেশ-মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল।
অর্থাৎ দেশের মূল ক্ষমতা কেন্দ্রে দৃশ্যত: আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা সত্বেও সেই আওয়ামী লীগেরই প্রতিষ্ঠাতাও সভাপতি মওলানা ভাসানী কেন অপর একটি রানৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহবান করলেন-তার পটভূমি উল্লেখ করা প্রয়োজন।
১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ঐ বছরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত হয়ে শেরে বাংলা এক.কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গ দলগুলির মনোনীত প্রতিনিধিদের সমান্বয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় মন্ত্রীসভা গঠন করে কারারুদ্ধ নির্য্যাতীত কমিউনিষ্ট নেত্রী ইলামিত্রকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার অনুমতি দান, বন্দীমুক্তিসহ কতিপয় প্রগতিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এবং মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক করাচী থেকে ঢাকা আমার পথে কলকাতা অবতরণ করেন। সেখানে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় তিনি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্য বজায় থাকবে-এ জাতীয় বক্তব্য দেওয়ায় পূর্ববাংলার নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত মুসলিম লীগ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ষড়যন্ত্র করে মাত্র ৫৮ দিনের মাথায় শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার মন্ত্রীসভাকে বাতিল ঘোষণা করলে যুক্তফ্রন্টকে বাতিল ঘোষণা করলে যুক্তফ্রন্টের ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করে ঐ একই ষড়যন্ত্রের কারণে।
অকস্মাৎ দেখা গেলো কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, যিনি কৃষক শ্রমিক পার্টি সদ্য গঠন করে যুক্তফ্রন্টে শরিক হয়েছিলেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শপথ নিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে ঐ কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রী হিসেবে। শেরে বাংলা সম্পর্কে জানা না গেলেও, শহীদ সোহরাওয়াদী যে ঐ মন্ত্রীত্ব গ্রহণের আগে আওয়ামী লীগের কোন অনুমোদন নেন নি তা অনেকেরই জানা।
মওলানা ভাসানী তখন ছিলেন বিদেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে। তিনি বিদেশে থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে যুক্তফৃন্টের সৃষ্ট ভাঙ্গনের ও ঐ দুই নেতার মন্ত্রীত্ব গ্রহণ ও পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরী শাসন প্রবর্তনের কঠোর সমালোচনা করে এক বিবৃতি দিলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া তা লুফে নেয়। পাকিস্তান সরকার ঘোষণাদের, মওলানা ভাসানী পাকিস্তানে ফিরলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে। তখন পূর্ব বাংলার বহু সংখ্যক এম.এল.এ. যেমন শেখ মুজিবর রহমান, আতাউর রহমান (রাজশাহী), হাজী মোহাম্মদ দানেশ সহ হাজার হাজার নেতা কর্মীকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করা হয়। স্বভাবত:ই বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বিশ্বশান্তি পরিষদের সম্মেলন শেষে যখন তিনি দেশে ফিরবেন-তখন গোপনে তাঁকে জানানো হয় ঐ মুহুর্তে ঢাকায় না ফিরে তিনি যেন দিলি বা কলকাতায় অবস্থান করেন এবং দল থেকে গ্রীন সিগন্যাল পাবার পরেই যেন তিনি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। সেই অনুযায়ী তিনি কলকাতায় অবস্থান করতে থাকেন সেখানকার একটি হোটেলে। সেখান থেকেও তিনি দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহŸান করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র রুখবার আহŸান জানিয়ে একাধিক বিবৃতি দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে যখন আবারও আতাউর রহমান পূর্ব বাংলার মুখ্য মন্ত্রী হলেন কোয়ালিশন সরকারের, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানী দলের সমর্থনে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হন। তখন তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসন, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট পাকিস্তানের বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করায় মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের বামপন্থী অংশ ক্ষিপ্ত হন। মওলানা ভাসানী কাগমারীতে একটি সম্মেলন ডাকেন। তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও অপর চারজন আওয়ামী লীগ জলীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার সকল সদস্য ও পূর্ব বাংলার সকল জেলার বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগের সকল জেলা বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগার যোগ দেন।
সেখানে অনুষ্ঠিত বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে আলোচনায় আসে সোহ্রাওয়ার্দী অনুসৃত স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট ও সাম্রাজ্যবাদ-ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি। মওলানা ভাসানী সোহরাওয়াদী অনুসৃত নীতিসমূহের কঠোর সমালোচনা করে তাঁকে দলীয় রীতি অনুসরণের আহবান জানালে সোহ্রাওয়াদী তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, স্বায়ত্ত¡শাসন মানলে, এক ইউনিট ভাঙ্গলে ও পররাষ্ট্রনীতি বদলালে পাকিস্তান টিকবে না। ব্যাপক আলোচনার পর বিপুল ভোটাধিক্যে মওলানা ভাসানীর অভিমত অনুমোদিত হয়। ক্ষুব্ধ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর অনুসারীরা তৎক্ষণাৎ ঢাকা ফিরে যাব এবং দলের পাল্টা কাউন্সিল সভা আহবান করেন। এ সভায় সোহরাওয়ার্দী অনুসৃত ঐতিসমূহ অনুমোদিত হয় বলে ঘোষণা দিলে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীও মওলানা ভাসানীর সমর্থনে দল থেকে পদত্যাগ করেন।
এই পটভূমিতে আহুত হয় “নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন দুই দিন ব্যাপী। তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম-যোগ দিয়েছিলাম এ সম্মেলনে। তাই আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
ধারণাতীতভাবে সকল হয় এই সম্মেলন। পূর্ব বাংলার মওলানা ভাসানী, মহীউদ্দিন আহম্মেদুল কবীর, মওলানা আহম্মেদ রহমান আকম্য হাজী মোহাম্মদ দানেশ, মাহমুদ আলী মসিউর রহমান যাদুমিয়া, পীর হাবিবুর রহমান, ওয়াপলিশ আহাদ, কাজী আবদুল বারি আবদুল মতিন (ভাষা মতিন), আবদুল হক, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, আতাউর রহমান, সেলিনা বানু প্রমুখ, সিন্ধু প্রদেশ থেকে সিন্ধ মাহাজ নেতা জি.এম. সৈয়দ ও আবদুল মজিদ সিনধি, সিন্ধ হারি কমিটির নেতা হায়দার বখশ, আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক ওসমানী; উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খোদাই খিদমতগার নেতা খান আবদুল গফফার খান, ওয়ালিশ খান; বেলুচিস্তান থেকে গাউস বখ্শ্ বেজেঞ্জো, খায়ের বখশ মারী কালাতের প্রিন্স করিম খানা, ওলখান নাসির; পাঞ্জাব থেকে মিঞা ইফতিখার উদ্দিন, হাসান নাসির প্রমুখ।
ক্ষমতাসীন আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের একটি দক্ষিণপন্থী অংশ সাবেক ছাত্র লীগ নেতা আবদুল আউয়াল প্রমুখ এই সম্মেলনস্থল আক্রমণ করে, প্রয়োজনে রূপমহল সিনেমা হলে আগুন দিয়ে এই সম্মেলনকে বানচাল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাঞ্জাবের সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতা ও প্রখ্যাত প্রগতিশীল ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান টাইমস্ এর প্রকাশক মিঞা ইফতিখার উদ্দিনকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সম্মেলনে আসার পথে রাস্তায় ট্যাক্সিতে অবস্থানকালে আকস্মিক আক্রমণের শিকার হন, পাথরে ঢিল লেগে ট্যাক্সির কাচ ও মিঞা ইফতিখার উদ্দিনের একটি হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তিনি পথিমধ্যে এক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ওষুধপত্র সহ ভাঙা হাত (ব্যান্ডেজ সহ) নিয়ে সম্মেলন স্থলে উপস্থিত হন।
সম্মেলনের প্রথম দিন দুপুরের দিকে গোপনসূত্রে পৌঁছানো এক খবরে মওলানা ভাসানী জানতে পারেন, সিনেমা হলটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে। তৎক্ষণাৎ মওলানা ভাসানী সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে ঐ ষড়যন্ত্রের কথা এবং আহবান জানান কোন ডেলিগেট যেন পরদিন সম্মেলন শেষ হওয়ার আগে কোন কারণেই রূপমহল সিনেমা হলের বাইরে না যান। আরও বলেন, পরদিন ২৫ জুলাই সম্মেলন শেষ করে সকলে পল্টন ময়দানে গিয়ে জনসভা করা হবে। অত:পর সকলে যার যার মত সুশৃখলভাবে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন। এই আহবান সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ডেলিগেট অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ঐ হলেই একাধিক টয়লেট, বাথরুম ও আহারাদি এনে প্রতিদিন তিন দফা খাবার ব্যবস্থাও করা হয়।
২৫ জুলাই সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয়, নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার যে দলের লক্ষ্য হবে সা¤প্রদায়িকতা বিরোধিতা এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক যুদ্ধ ও যুদ্ধ উম্মাদনার বিরোধিতা করা এবং জাতীয় অর্থনীতিকে শোষণমুক্ত করে সমাজতন্ত্র ও বৈষম্য মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা ও নারী-পুরুষের সমতা বিধান করা।
দলের নাম স্থির হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তবে বেশীর ভাগ নেতা চাইছিলেন ন্যাশনাল ডেমোক্রটিক পার্টি নাম রাখতে। মওলানা ভাসানী বলে ওঠেন, দলের নাম যা-ই রাখা হোক তাতে “আওয়ামী” শব্দটি যেন রাখা হয়। সে অনুযায়ী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নাম রাখা হয় সর্বসম্মতিক্রমে। দলটির মেনিফেষ্টো ও গঠনতন্ত্র ও সবর্কসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হলে সকল ডেলিগেটের করতালিতে হল মুখরিত হয়।
নতুন কমিটি গঠন করা হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং করাচীর মাহবুবুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী এবং মহিমুদ আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মাহমুদ আলী তখন আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের একজন মন্ত্রী তিনিও দুই দিন ধরে ঐ সিনেমা হলে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
কমিটি গঠন এবং প্রস্তাবাদি অনুমোদনের পর সকল ডেলিগেট মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সদর ঘাটের রূপমহল সিনেমা হল থেকে পল্টন ময়দানে মিছিল করে অগ্রসর হতে থাকলেনবাবপুর রোডের উভয় দিক থেকে বহুতল ভবনগুলির ছাদ থেকে মিছিল ও নেতাদেরকে লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্তভাবে ইঁট পাটকেল নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। এগুলিকে উপেক্ষা করে মিছিলটি পল্টন ময়দানে পৌঁছানোর সাথে সাথে মওলানা ভাসানী সহ সকল নেতাকে লক্ষ্য করে ইষ্টক বৃষ্টি হতে থাকে। অনেকে রক্তান্ধ হন। তার মধ্যেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মওলানা ভাসানী কঠোর ভাষায় বলেন, আপনারা দেখুন আওয়ামী লীগ সরকার একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল ও জনসভাকে পÐ করতে কিভাবে গুÐা লেলিয়ে দিয়েছে। আমরা আগামীতে নির্বাচনে মাধ্যমে আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সরকার গঠন করবো।
এই বলতেই ব্যাপক পাথর বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রাদেশিক ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী মাহমুদ আলী দাঁড়িয়ে বলেন,“আওয়ামী লীগের এই গুÐামির প্রতিবাদে আমি মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করলাম।
ইতিমধ্যে পুলিশের তৎকালীন ডি.আই.জি (ব্যক্তিগতভাবে মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল) আবদুল্লাহ ছুটে এসে বলেন, “হুজুর, ওরা আপনাকে বাঁচতে দেবে না। সরকার ইতিমধ্যেই সভার ময়দানে ১৪৪ ধারা জারী করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।”
বাধ্য হয়ে নেতৃবৃন্দকে সামনে ঘিরে রেখে পেছনে হাজার হাজার কর্মী ও কিছু সংখ্যক পুলিশ পুনরায় সুশৃংখল মিছিল করে সদরঘাটে পৌঁছালে সম্মেলনের কাজ শেষ হয়।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের বেশীর ভাগ ট্রেনে এসে ঢাকার রেলওয়ে ষ্টেশনে নেমেই গগণবিদারী শ্লোগান তুলেছিলেন “মাশরেকী আউর মাগরেবি পাকিস্তান কি আওয়াম ইত্তেহাদ” (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ঐক্য জিন্দাবাদ)। সেখানে ছাত্র ইউনিয়নের শত শত কর্মী আমরা তাঁদেরকে পাল্টা জনঐক্যের বিজয় ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পতন কামনা করে শ্লোগান দিয়ে তাঁদেরকে সম্বর্ধনা জানাই ঢাকার সাবেক রেলষ্টেশন ফুল বাড়িতে এবং মিছিল সহকারে তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে সম্মেলনস্থল সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে পৌঁছাই। তখন আগতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিন্ধু প্রদেশের যুব কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড হাসান নাসির যাঁকে পরবর্তীতে সামরিক সরকার লাহোর দুর্গে ফাঁসিতে লটকিয়ে হত্যা করেছিল। সর্বাধিক শ্লোগান দিয়ে গোটা সম্মেলনস্থল কাঁপাচ্ছিলেন তিনি।
সে এক ব্যাপক উত্তেজনা যা সে সময়কার উভয় পাকিস্তানের যুব সমাজকে উদ্বেলিত করেছিল। ন্যাপ গঠনের মাধ্যমে উভয় পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মানুষের ঐক্য সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল প্রদেশে ন্যাপের শক্তিশালী শাখা গঠিত হয়। সকল প্রদেশেই জননন্দিত নবীন ও প্রবীণ নেতাদের নেতৃত্বে একই লক্ষ্যে জনগণ সংগঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে সমশ্চিত বাম ও উদার গণতন্ত্রী শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগে গণ আন্দোলন সৃষ্টির ভিত্তি রচিত হয়েছিল। দুই অঞ্চলের নিষিদ্ধ গোপন কমিউনিষ্ট পার্টিও ন্যাপের মাধ্যমে সক্রিয় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পাকিস্তান উত্তরকালে প্রথমবারের মত সক্ষম হয়েছিল-যা ন্যাপের জন্মের এক মুহুর্ত আগে পর্য্যন্ত কল্পনা করাও সম্ভব হয় নি। প্রথমবারের মত সক্ষম হয়েছিল-যা ন্যাপের জন্মের এক মুহুর্ত আগে পর্য্যন্ত কল্পনা করাও সম্ভব হয় নি।
আজ সাম্প্রদায়িকতা, কালো টাকা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীন ও উগ্রপন্থীদের কারণে সমগ্র জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হওয়ায় প্রগতিশীল বামধারার রাজনীতি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তদুপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সংঘটিত বিপর্য্যয় এবং দেশের বামপন্থী দলগুলি যেমন ন্যপ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টিতে নানা কারণে অনাকাংখিত ও ভয়াবহভাবে ক্ষতিকর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বামশক্তিগুলির গণভিত্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্য্যন্ত ন্যাপ ও বাম দলগুলির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য্য।
কিন্তু জনজীবনের ক্রমবর্ধমান নিত্যদিনের সমস্যা, পুঁজিবাদী শোষণ যেভাবে দিনে দিনে তীব্র হয়ে উঠছে এবং বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তির কার্য্যত: অনুপস্থিতির কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শূণ্যতার সৃষ্টি করেছে-তাতে বিশ্বাস করার কারণ আছে যে দেশের অবহেলিত যুবসমাজ বাম প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকা পুনরায় ঊর্ধে তুলে ধরে ধারাবাহিক লড়াই এর মাধ্যমে নতুন লড়াই এ সামিল হবে ও ঐ শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত একটিই-আজকের বাপন্থী দলগুলি ওতাদের নেতা-কর্মীকে উপলব্ধি করতে হবে যে দ্রæত সকল বামপন্থী শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ঐ প্রক্রিয়াকে কার্য্যকর করতে সর্বাধিক প্রয়োজন। হতাশা ও প্রস্তাব নির্ভর না হয়ে ঐক্যের ব্রাপারে সক্রিয় উদ্যোগের সাফল্য অনিবার্য্য।
লেখক-
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।