বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
একটি জাতির জনক গোটা জাতির সর্বাধিক অমূল্য সম্পদ। জনকের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁর আদর্শ অন্তরে ধারণ করা এবং তা সযতনে লালন ও বাস্তবায়ন করা যে কোন জাতির জীবনের এক অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর দিকে দিকে তাকালে আমরা তার বেশ কিছু নজির দেখতে পাই। আবার বিপরীত তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
বঙ্গবন্ধু তর্কাতীতভাবে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ। তাঁর ধারাবাহিক অবদান আমাদের মহামূল্যবান স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সীমাহীন প্রেরণা। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় দেশে-বিদেশে তা স্বীকৃত পরম শ্রদ্ধার সাথে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার শত্রæপক্ষ অবশ্য নানাভাবে ঐতিহাসিক ঐ সত্যটিকে বারংবার বিকৃত করতে চেয়েছে নানাভাবে দীর্ঘদিন যাবত সে অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সে অপচেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়েছে। তারা বলতে চেয়েছে, যেহেতু শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধাকলে পাকিস্তানের কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন এবং তাঁর উপস্থিতি ব্যতিরেকেই যেহেতু নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তাঁদের অবর্তমানেই ঐ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেই হেতু তিনি বাঙালি জাতির জনক হতে পারেন না।
এ বক্তব্য যে উদ্দেশ্যমূলক এবং পাকিস্তান ফিরে পাবার আশায় উম্মাদ নানামহলের উদ্দেশ্যমূলক ভাবনার প্রকাশ মাত্র-তা বুঝতে কারও বেশী একটা সময় লাগে নি। ক্ষমতায় এসে এমন প্রচার করায় কিছু সংখ্যক মানুষ সাময়িকভঅবে বিভ্রান্ত হলেও ইতিহাস তার নিজের শক্তিতেই সে বিভ্রান্তি দূর করেছে।
কিন্তু যাঁরা এ জাতীয় অপপ্রচার বা বিভ্রান্তির শিকারে কোনদিনই সামান্যতম প্রভাবিত হন নি, জাতির জ নকের অকাল এবং নির্মম হত্যালীলা বা তার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে কতটুকু ভূমিকা রেখেছেন-তা বঙ্গবন্ধু প্রয়াসের দীর্ঘ চার দশক পর নির্মমভাবে ভাবনার সময় নিশ্চয়ই এসেছে।
১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস। আগষ্ট মাস শোকের মাস। এই মাসে আজ থেকে ৪৬ বছর আগে একটি মর্মান্তিক হত্রাকাÐের মাধ্যমে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাৎক্ষণিক আমরা কতটা কি করেছি-তাও অপরিহার্য্যভাবে তাবার বিষয়। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভাবান বিষয়টি হলো এই মৃত্যু কি অবধারিত ছিল বা অপ্রতিরোধ্য ছিলো? এর উত্তরে এক কথায় “হ্যাঁ” বা “না” বলা সম্ভব হলেও তা অনুচিত কারণ তাতে পূর্ণাঙ্গ সত্যমানুষের সামনে অনুপস্থিত থেকে যাবে।
এই আলোচানায় এটা উল্লেখ করা অপরিহার্য্য যে মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে, বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের লালিত আকাংখাকে ব্যর্থ করে দিতে ষড়যন্ত্র বেশ জোরে সোরেই শুরু হয়েছিল ম ুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুজিবনগর থেকে। শহীদ তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি খোন্দকার মোশতাক এই ষড়যন্ত্রের হোতা। কোলকাতার মার্কিন দূতাবাসে তিনি গোপনে যাতায়াত করতেন এবং আমেরিকার ও পাকিস্তানের সাথে সমঝোতা করে একটি হালকা কনফেডারেশনের অন্তর্ভূক্ত থেকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত একটি প্রকটি প্রদেশ হিসেবেই থাকতে বাংলাদেশ সরকারকে রাজী করানো। এই ষড়যন্ত্র ভারত সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী উদ্ধার করে তাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহিত করলে তিনি তৎক্ষণাৎ বিষয়টি তাজ উদ্দিন আহম্মেদকে অবহিত করলে তিনি খোন্দকার মোশতাককে বিদেশ মন্ত্রীর পদ অপসারণ না করে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের তাবৎ দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ঐ দায়িত্ব অর্পন করেন। ভারত সরকার খোন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দী করে রাখেন যাতে তিনি কোন বৈদেশিক শক্তির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারেন। এভাবেই সে ষড়যন্ত্র আঁতুড়েই বানচাল করে দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়।
খোন্দকার মোশতাকের যুক্তি ছিল-একমাত্র কনফেডারেশনের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই পাকিস্তানের আটক শেখ মুজিবকে বাঁচানো সম্ভব। এই কথাও যে ঐ ষড়যন্ত্রেরই অংশ তা বুঝতে ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কোন কষ্ট হয় নি। তাই প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধ সফল করে তুলে তার মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অতীতের এ ইতিহাসের বয়ানকে সামনে রেখে স ফল মুক্তিযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা হয় এবং ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী ড. কামাল হোসেন সহ লষ্ভন, দিল্লী হয়ে ঢাকা এসে পৌঁছান। সমগ্র জাতির দুশ্চিন্তার অবসান হয়।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে আবেগাপ্লুত লাখো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় সিক্ত হয় তাঁর বাসভবনে ফিরলেন। পরদিনই রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, ঐ মন্ত্রীসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে স্থান পেলেন সেই কনফেডারেশন-প্রত্যাশী খোন্দকার মুশতাক আহমেদ। ততোধিক বিস্ময়ের, ম ুজিবনগর থেকে ঢাকা ফিরে তাজউদ্দিন যে সম্প্রসারিত ম ন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতেও স্থান পেয়েছিলেন ঐ ষড়যন্ত্রকারী নেতা।
বছর আড়াই যেতে না যেতেই মুক্তিযুদ্ধের সফলতম পরিচালনাকরী, মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে অনুযায়ী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করতে হলো। বিশ্বস্ত মন্ত্রী হিসেবে দিব্যি থেকে গেলেন খোন্দকার মুশতাক। ফলে বিষয়টা দাঁড়ালো-পাকিস্তান-আমেরিকা-চীনের সাথে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল হোতা মন্ত্রীসভায় থাকার সুবাদে সরকারের সকল সিদ্ধান্ত অবহিত করার সুযোগ পেলেন আর ঐ ষড়যন্ত্র মুজিবনগরে বানচাল করে দেওয়ার প্রধান কাওরী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এভং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বাধি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যশীল তাজউদ্দিন চলে গেলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে।
সকলেরই জানা, ১৯৭১ এ ব্যর্থ হলেও মুক্তিযুদ্ধের বা ব াংলাদেশের অভ্যুদয়ের সক্রিয় বি রোধিতা করেছিল সেই দেশী-বিদেশী শক্তিগুলি পরাজয় মেনেব নেয় নি-বরং নতুন উদ্যমে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
এই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বন্ধু সুলভ দেশগুলির গোয়েন্দা বাহিনী খবর পাওয়া মান্ত্রই তাদের নিজ নিজ সরকারকে অবহিত করেছে। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি, ভারতের ‘র’ বুলগেরিয়ার তৎকালীন ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত খবর পেয়ে যায়, বাংলাদেশের শত্রæরা বঙ্গবন্ধুকে শীঘ্রই হত্রা করবে-এমন ষড়যন্ত্র এঁটেছে। সেখবর নানা সূত্রের মাধ্যমে যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীম তি ইন্দিরা গান্ধী, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তৎকালীন সাধারন সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলে তিনি বলেন, কোন বাঙালি সন্তান আমার গায়ে হাত তুলবে না। তোমরা বরং সাবধানে থেকো। এমন কি, বঙ্গবন্ধুকে যখন তাঁর আপন ভগিনেয় শেখ ফজলুল হক মনি অনুরোধ করেন, “এই মুহুর্থে খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রীসভা থেকে পদচ্যুত করে তাকে এবং অপরাপর ষড়যন্ত্রকারী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর (এঁরাও ছিলেন মন্ত্রী সভার সদস্য) কেও পদচ্যুত করে গ্রেফতার করে জেলে না পাঠালে দেশটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং তাঁর জীবন বিপন্ন হ তে পারে। শেখ মনিকেও তিনি পাত্তা দেন নি এবং একই কথা বলে বিদায় দেন।
আমেরিকা তার আগে ঐ মন্ত্রীদের এবং সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণকর্মকর্তাদের সাথে ঢাকাস্থ দূতাবাসে ঘন ঘন বৈঠক করার খবরও জানতে পারা গেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু থাকলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল।
অপরদিকে ক্যান্টমেন্টও হয়ে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের অন্যতম নিরাপদ কেন্দ্র। পরবর্তীতে আত্মস্বীক্রত খুনীরা যেমন মেজর ডালিম প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধু হত্রার কথা স্বীকার করেছিলেন।
১৫ আগষ্ট ছিল ঢাাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনত্তর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়েল চ্যান্সেলার হিসেবে তিনি তাতে যোগ দেবেন ফলে এই প্রস্তুতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের স্বাভাবিক ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু যাবেন সে কারণে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে বলে সামরিক বাহিনীর গাড়ী ঘোড়া এমন কি ট্যাংক চালানো হলেও মানুষ তাতে সাদাচোখে দেখে সন্দেহের কিছু পাননি।
লেখক-
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ