বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
কামরুল হাসান, ময়মনসিংহঃ
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙ্গালী নারীদের কোন মান-মর্যাদা ছিল না, ছিল না আত্মপরিচয়। পুরুষদের চারপাশে একটি সীমিত গন্ডির মধ্যে ছিল তাদের যাবতীয় পরিচয়। মেয়েরা স্কুলে যাওযার সুযোগ পেত না, পেত না কথা বলার সুযোগ। নারীদের স্বকীয় একটা জীবন আছে, পুরুষরা তখনও
ভাবেনি। তখনও নারীদের স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হত। এর একটি বড় কারণ ছিল, নারীরা তখন স্বনির্ভর হয়ে গড়ে ওঠেনি। তখনও স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়নি, বঙ্গ ভঙ্গ হয়নি। সে দিন রুদ্রবীনা বেজে ওঠে। অসহায়, দুর্বল,হতাশাগ্রস্থ আবাল বৃদ্ধ বণিতা সেই বীনার সুরের ঝঙ্কারে একাত্মতা ঘোষণা করে, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সেই বীনা বাজিয়ে যে বৈপ্লবিক আলোকবর্তিকা, সমাজে নারী প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন তিনি হলেন ভারত উপমহাদেশের প্রথিতযশা বাঙ্গালি সাহিত্যিক, সমাজ সেবক ও
বুদ্ধিজীবী সরলা দেবী চৌধুরানী।
“শুভ জন্ম দিন।”
১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে ৯ সেপ্টেম্বর সরলা দেবী চৌধুরানী ( Sarala Devi Chaudhurani )মাতুলালয় কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জানকীনাথ ঘোষাল জমিদার্। তিনি নদীয়ার জয়রামপুরের জমিদার ছিলেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তিনি
বেঙ্গল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাবা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন স্বাধীন ও মুক্তমনের মানুষ। মা স্বর্ণ কুমারী ছিলেন তখনকার সময়ের সফল লেখিকাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মা ঠাকুরবাড়ীর মেয়ে তাই নিজের মহলে আলাদা সব সময় স্বতন্ত্র, একাকী থাকতেন, নিজের সন্তানদের ও খুব বেশী ধারে কাছে
ঘেঁষতে দিতেন না। ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের তখন ঘরজামাই রাখার রেওয়াজ ছিল। এর সুবাদে ও তাঁর পিতার বিলেতে প্রবাসে থাকার কারণে সরলা দেবীর জোঁড়াসাকো ঠাকুরবাড়ীতে বেড়ে ওঠার সুযোগ পান।
সরলা দেবীর দাদু ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় স্বাধীন ভারতে প্রথম ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে ভারতের ক্রীড়া-ইতিহাসকে উজ্জল করে রেখেছেন। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর ছোট মামা। তাঁর স্বামীর নাম রামভূজ দত্ত চৌধুরী। রামভূজ পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী সাংবাদিক
এবং দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্য সমাজের একজন সদস্য । তাদের এক সন্তান ছিল দীপক দত্ত চৌধুরী।
সরলা দেবী বেথুন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে এন্ট্রাস পরীক্ষা পাস করেন মাত্র তের বছর বয়সে এবং বেথুন কলেজে ভর্তি হন। পরে বেথুন কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মাত্র আঠার বছর বয়সে বি.এ পাস করেন। পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন। সূত্রের ভিত্তিতে জানা যায়, কিছু দিন স্বনামধন্য চিকিৎসক মহেন্দ্রনাথ লাল সরকারের কাছে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়ার কথা । পড়াশুনা শেষ করে মহীশুরে চলে যান এবং মহারানী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মা
স্বর্ণকুমারী দেবীর সাথে যুগ্নভাবে ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদন করতে শুরু করেন। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এককভাবে এই পত্রিকা সম্পাদন করেন। তখনকার সময়ে এটি বাংলা সাহিত্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ বিরোধী শাসন নির্মূল করার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য গুরুত্ব পূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার বউবাজার এলাকায় তখনকার সময়ের নারীদের দ্বারা সূষ্টি
করা হস্তশিল্পকে আরও উজ্জীবিত, অনু্প্রাণিত ও সংগঠিত করার জন্য ‘লক্ষ্মী ভান্ডার’ নামক একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি আরও অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারতের এলাহাবাদে ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল ‘( All India Women’s Organization ) নামক আরেকটি সংস্থা তৈরী করেন। এটিই ছিলভারতবর্ষের প্রথম সর্বভারতীীয় সংগঠন। তিনি একজন সংগীত শিল্পী ছিলেন। ১৯০০ খ্রীষ্টব্দে তাঁর রচিত ১০০টি দেশাত্মবোধক গানের একটি গ্রন্থ শতগান প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছেঃ বাঙালির পিতৃধন (১৯০৩), ভারত-স্ত্রী-মহামণ্ডল (১৯১১), নববর্ষের স্বপ্ন (গল্প, ১৯১৮), জীবনের ঝরাপাতা (আত্মজীবনী, ১৯৪৫), বেদবাণী (১১ খণ্ড), শিবরাত্রি পূজা ইত্যাদি। একবার সরলা দেবী চৌধুরাণী ময়মনসিংহের সুহৃদ সমিতির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসায় সংগঠনের কিছু দামাল ছেলেরা ময়মনসিংহের রেল ষ্টেশন থেকে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসার সময় প্রথম স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল ময়মনসিংহ।
“ বন্দে মাতরম”। সেই থেকেই শুরু। এর পর তিনি নিজে গেয়ে ‘বন্দে মাতরম’ কে গোটা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। আজও বাঙ্গালী জাতির বন্দে মাতরম স্লোগানে গায়ের প্রতিটি শিরা উপশিরাকে শিহরিত করে, আন্দোলিত করে, জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার রেল ষ্টেশনের পাশেই সরলা দেবী চৌধুরানীর জমিদার বাড়ী। বিশাল এলাকা জুড়ে অনেক ছড়ানো ছিটানো অনেক পরিত্যক্ত দালান দেখা যায়। পুরাতন এই দালানগুলো কালের সাক্ষী হয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে।
জমিদার বাড়ীর চারিদিকে অনেক ছোট বড় পুকুর রয়েছে। সরলা দেবী চৌধুরানী নিরাপত্তার কথা ভেবে জমিদার রাড়ীর পিছনের দিকে ঢুলমার খাল নামে পরিখা খনন করান। এই পরিখা দিয়ে তিনি গোপনে নৌকা যোগে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে সরলা দেবী চৌধুরাণী না ফেরার দেশে চলে যান।