শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 6 minutes
দ্বিতীয় বার ১৯৭৭ সালে। জরুরি অবস্থার লৌহকঠিন অনুশাসনের পর ইন্দিরা সরকারের পরাজয়ের আকস্মিকতা প্রায় ভূমিকম্পের মতো মনে হয়েছিল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা উত্তর ভারতে কংগ্রেস ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। সেই অভাবনীয় অভিজ্ঞতার দু’মাস পরে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বিপুল জয় কিছুটা যেন প্রত্যাশিতই ছিল। সে বারের পালাবদল আনল স্থিরতা, কিছু পরিমাণে সামাজিক শান্তি। সাতটা বিধানসভা নির্বাচন জিতল বামফ্রন্ট। মনে হতে লাগল, বাম-শাসন যেন অপরিবর্তনীয়।
কিন্তু না, ২০১১-তে সত্যি পালাবদল হল। সেটা যে আকস্মিক ঘটনা ছিল, তাও নয়। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনেই বোঝা গিয়েছিল, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের প্রভাব বহু দূর ছড়িয়ে পড়েছে। আজীবন বাম সমর্থকদের অনেকেই আর বাম সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারলেন না। কংগ্রেস থেকে উঠে আসা তেজস্বিনী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম-বিরোধী জনমত একত্র করে ক্ষমতায় এলেন।
গোড়ায় মনে হয়েছিল, পালাবদল হলেও রাজনীতির ধরন বোধ হয় কিছুই বদলাল না। কংগ্রেস আমলে বাংলার গ্রামাঞ্চলে সামাজিক ক্ষমতা ছিল জমিদার, বড় জোতদার আর গোষ্ঠীপতিদের হাতে। তাদের মাধ্যমেই কংগ্রেস ভোট সংগ্রহ করত। বাম আমলে জমির মালিকানায় বড়সড় পরিবর্তন ঘটল। বড় জমির মালিক আর বিশেষ কেউ রইল না। তাদের ছেলেমেয়েরা সব শহরবাসী হয়ে গেল। গ্রামসমাজের কর্তৃত্ব চলে গেল মাঝারি-ছোট চাষি-সমর্থিত বাম পার্টির হাতে। জমিদারের কাছারি, জাত-পঞ্চায়েত লোপ পেল। গ্রামসমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান— পঞ্চায়েত, স্কুল কমিটি, পুজো কমিটি, ক্লাব দখল করে নিল পার্টি। যেখানে বাম-বিরোধী কংগ্রেস টিকে রইল, বাম-সমর্থক ক্লাবের বিপক্ষে হল কংগ্রেস-সমর্থক ক্লাব। তৃণমূল আসার পর গোড়ার দিকে এই ছকটা বদলায়নি, শুধু বামকে উৎখাত করে তৃণমূল সব প্রতিষ্ঠানের দখল নিয়েছিল।
ক্রমে দেখা গেল, তৃণমূলের শাসনপদ্ধতি ভিন্ন। দল এবং সরকারি প্রশাসন, দুইয়ের উপরেই সর্বাঙ্গীণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন মমতা। এমন কেন্দ্রীভূত ব্যক্তিতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গ আগে দেখেনি, যদিও তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে অনেক দিন ধরেই তা রাজ্যশাসনের পরিচিত ছক। দক্ষিণ ভারত থেকে আরও একটি ছক নিয়ে এলেন মমতা। তা হল, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিশেষ সাহায্য প্রকল্প। জনবাদী রাজনীতির এই কৌশল বিপুল ভাবে ব্যবহার করলেন মমতা, তাঁর জনসমর্থন পোক্ত করার জন্য। খাদ্যসাথী, কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু ইত্যাদি নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি সাহায্য পৌঁছে দিতে লাগলেন দরিদ্র শ্রেণি, ছাত্রছাত্রী আর মহিলাদের কাছে। মুসলিমদের একটা বড় অংশ ওবিসি সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে লাগল। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি জঙ্গলমহলের মাওবাদীদের সমর্থন নিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে প্রথমে তাদের দমন করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন। দার্জিলিংয়ে বিমল গুরুং-কে শায়েস্তা করার জন্য তিনি লেপচা, তামাং, লিম্বু ইত্যাদি গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা পার্বত্য জনজাতি পরিষদ গঠন করলেন। কিন্তু হাজার হাজার ক্লাবকে সরকারি অর্থ দিয়ে তৃণমূলের কর্মীদের খুশি রাখার ব্যবস্থা হল। দলের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন মমতা নিজে।
এই কেন্দ্রীভূত জনবাদী শাসনব্যবস্থার ফলে ২০১৬-র নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের সম্মিলিত বিরোধিতা অতিক্রম করে তৃণমূল সরকার আবার নির্বাচিত হল। কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও বিজেপি সে বার পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি। বিজেপির রমরমা দেখা গেল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে। সবাইকে চমকে দিয়ে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ১৮টা আসন জিতল। দেখা গেল, রাজ্যে বিজেপি হয়ে উঠেছে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। আওয়াজ উঠল, অসম-ত্রিপুরার মতো পশ্চিমবঙ্গেও পালাবদল হয়ে বিজেপি আসতে চলেছে।
প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতা
বিজেপি নেতারা এখন বলছেন, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। এ বার ‘আসল পরিবর্তন’ হবে। সেটা কী? এ বারের নির্বাচন উপলক্ষে বিজেপি যে ইস্তাহার প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি আসলে তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের বর্ধিত সংস্করণ। তাতে কৃষকদের জন্য আরও বেশি আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস আছে। মহিলাদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য, বর্ধিত ভাতা দেওয়ার কথা আছে। বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ মহিলাদের সংরক্ষণ হবে। প্রতি পরিবারে অন্তত এক জনের কর্মসংস্থান হবে। প্রভূত পরিমাণে শিল্পবিনিয়োগ বৃদ্ধি, পরিকাঠামোর উন্নতি, পর্যটন শিল্পের প্রসারের কথা আছে ইস্তাহারে। বলা হয়েছে, মাহিষ্য, তিলি ও অন্য জাতিদের ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে, পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় উন্নয়ন বোর্ড হবে, মতুয়া দলপতিদের মাসিক পেনশন দেওয়া হবে। গঙ্গাসাগর মেলার প্রসার, চৈতন্য মহাপ্রভুর মতাদর্শ প্রচার, পুরোহিত কল্যাণ বোর্ড প্রতিষ্ঠা, কীর্তনীয়াদের পেনশন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ যে মুসলিম, তার ছিটেফোঁটা স্বীকৃতি অবশ্য ইস্তাহারের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ থেকে পরিষ্কার, জনবাদী খয়রাতি আর সুযোগসুবিধা বণ্টনের পদ্ধতি পুরোপুরি গ্রহণ করে নিয়েছে বিজেপি। বস্তুত, তৃণমূলের সঙ্গে জনবাদী রাজনীতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে মোদী-শাহের দল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষিত রাজনৈতিক মতের সঙ্গে মেলাতে গেলে এতে খটকা লাগতে পারে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে মোদী বলে এসেছেন যে, কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকার অথবা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের ঢালাও জনবাদী বিলিব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত। এই সব খরচ আসলে অপব্যয়, তাতে কোনও স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হয় না। বিজেপির আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে এই সব তথাকথিত সামাজিক ব্যয় গত কয়েক বছরে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেই সামাজিক ব্যয় বহু গুণ বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। ব্যাপারটা কী? এত খরচ করার টাকা আসবে কোথা থেকে, জিজ্ঞাসা করায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, “আমি বানিয়া। আমি জানি কী করে টাকা জোগাড় করতে হয়। আমায় বিশ্বাস করতে পারেন।”
কথাটার ভিতর এক ক্ষুরধার রাজনৈতিক কূটকৌশল লুকিয়ে আছে। কাকে ভোট দেব, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভোটদাতার প্রধান হিসেব যদি হয়, কে আমায় কত বেশি দেবে, তা হলে জনবাদী প্রতিশ্রুতির প্রতিযোগিতায় নামা ছাড়া ভোটপ্রার্থী রাজনৈতিক দলের আর কোনও উপায় থাকে না। বিজেপি সেটা পুরোপুরি মেনে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তার ইস্তাহার তৈরি করেছে। সুতরাং নিশ্চিত ভাবে বলা যায়: এ বারের নির্বাচনে দলীয় ফলাফল যা-ই হোক না কেন, প্রতিযোগিতামূলক জনবাদ এই রাজ্যে পাকাপাকি ভাবে গেঁড়ে বসল।
কিন্তু বিজেপির এখানে একটা বিশেষ সুবিধা আছে। তার হাতে কেন্দ্রীয় সরকার, যে সরকারের খরচ করার ক্ষমতা যে-কোনও রাজ্য সরকারের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু সরকারি খরচ নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সুদূরপ্রসারী, তাদের পক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানদের কোনও বিশেষ রাজ্যে খরচ করতে বলার সম্ভাবনাও বিশ্বাসযোগ্য। তাই বিজেপি নেতারা রোজ বলে চলেছেন, বিজেপিকে জেতান, কেন্দ্রে-রাজ্যে একই দল শাসন করলে ডবল এঞ্জিন সরকার হবে, মানুষের প্রত্যাশা অনেক সহজে পূরণ হবে।
অসম-ত্রিপুরাতেও একই প্রলোভন দেখিয়েছিল বিজেপি। ত্রিপুরার নির্বাচনের সময় সেখানকার ভোটাররা অনেকে বলতেন, “সিপিএম নেতারা মোটের উপর সৎ, পরোপকারী। কিন্তু তাঁদের নিজেদেরই তো কিছু নেই, তাঁরা আর অন্যকে কী দেবেন? বিজেপির নেতাদের দেখছেন না, রোজ প্লেনে চেপে আসছেন, তাঁদের হাতে কত টাকা!” আজ যে বিজেপির নেতারা পশ্চিমবঙ্গে এসে পাঁচতারা হোটেলে দলীয় মিটিং করেন, তাতে সবার কাছে এই বার্তাই পৌঁছয় যে, তাঁদের অর্থসম্পদ আর সামাজিক প্রভাব গগনচুম্বী। তাঁরা গাঁধীযুগের সাত্ত্বিক জনপ্রতিনিধি নন, তাঁদের নেতৃত্বের স্টাইল রাজসিক।
বিভ্রান্তির অবকাশ নেই
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা হিন্দুত্ব নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য করছেন না। ব্যতিক্রম যোগী আদিত্যনাথ, যিনি এখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে গিয়েছেন। যে ডজন ডজন নেতানেত্রী-চিত্রতারকা সম্প্রতি দলে যোগ দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরাও হিন্দুত্ব নিয়ে কিছু বলছেন না। যেন বিজেপি ব্যাপারটা কেবল বাংলার উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত, হিন্দুরাষ্ট্রের প্রকল্পের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা হয় আত্মপ্রবঞ্চনা, নাহয় জেনেবুঝে চোখ বুজে থাকা। মোদী-শাহের নেতৃত্বে বৃহৎ পুঁজিপতিদের আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি কেন্দ্রীভূত হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগঠনের কাজ সমান তালে এগিয়ে চলেছে। এ নিয়ে কোনও বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
২০১৪-র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী বলতেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। হিন্দুত্বের কথা বলতেন না। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে কিন্তু মুসলিম-খ্রিস্টান বিরোধিতা অনেক বেড়ে চলেছিল। ২০১৭-তে যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গোরক্ষা, লাভ জেহাদ ইত্যাদি বিভিন্ন ছুতোয় মুসলিমদের উপর আক্রমণ তীব্রতর হল। ২০১৯-এর নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দুত্ববাদীদের দাবি এক-এক করে পূরণ করতে শুরু করে। ‘তিন তালাক’ বেআইনি ঘোষণা, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ, অযোধ্যায় নতুন রামমন্দির নির্মাণে সরকারি সাহায্য, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, সবই এই প্রকল্পের অঙ্গ। পাশাপাশি এল বড় পুঁজিপতিদের দাবি মেনে শ্রম আইন সংশোধন, নতুন কৃষিপণ্য আইন, বড় বড় সরকারি উদ্যোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আর বিমা কোম্পানি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব। রাষ্ট্রনীতির এই দ্বিবিধ গতিপথ মসৃণ করার জন্য দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত করা হতে লাগল। আর্থিক ব্যাপারে কেন্দ্রের পাল্লা ভারী হচ্ছিলই। জিএসটি আসার পর তা আরও বাড়ল। কেন্দ্রের প্রশাসনিক নির্দেশ রাজ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এমনকি, যে সব বিষয়ে রাজ্যেরই একমাত্র সাংবিধানিক অধিকার, তাতেও কেন্দ্রীয় সরকার আইন পাশ করছে, একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলেছে।
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের পিছনে রাজনৈতিক কারণ আছে। ২০১৪ সালে সারা ভারতে বিজেপি পেয়েছিল ৩১ শতাংশ ভোট। ২০১৯-এ তা বেড়ে হয় ৩৭ শতাংশ। তাতেই বিজেপি লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যদিও তার সদস্যরা এসেছিলেন প্রধানত উত্তর আর পশ্চিম ভারতের রাজ্য থেকে। অর্থাৎ, দেশের বৃহত্তর অংশে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপির সমর্থন বিশেষ নেই। সুতরাং, কেন্দ্রের ক্ষমতাকেই যত দূর সম্ভব ব্যবহার করে বিজেপিকে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন করতে হচ্ছে। অনেক রাজ্যে নির্বাচনে হারার পরেও বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। কিছু রাজ্যে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দিল্লিতে পরের পর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে অবশেষে সংসদে আইন পাশ করে দিল্লির রাজ্য সরকারকে ক্ষমতাহীন করার ব্যবস্থা করা হল ক’দিন আগে।
এই প্রসঙ্গেই হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে বাংলার উচ্চবর্ণ হিন্দু নেতারা এক সময় বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। দলীয় কারণে আজকাল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নামটা বারেবারে আসছে। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ লাহিড়ি প্রমুখ নেতাও হিন্দু মহাসভার সামনের সারিতে ছিলেন ভুলে যাওয়া উচিত নয়, চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বের অল্প কয়েক বছর বাদ দিলে বাংলায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব ধনী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতেই ছিল। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমর্থিত কৃষক প্রজা আন্দোলন। ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগ দাবি করেছিল মুসলিম দলগুলো নয়, প্রধানত শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুরা। সুতরাং, হিন্দুত্ববাদীদের কাছে বাংলার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে।
সুতরাং, বাংলায় এ বার পালাবদল হলে হিন্দুত্বের রাজনীতি যে এখানে জাঁকিয়ে বসবে, তা অবধারিত। জনবাদী খয়রাতি যে তেমন একটা বাড়বে না, তার প্রধান কারণ হল— কোনও বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এমন অঢেল খরচের ব্যবস্থা নেই। বিজেপির মতো দলের পক্ষে এক রাজ্যে বেশি খরচ করে অন্যদের বঞ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুপ্রবেশ আর মুসলিম তোষণ নিয়ে অভিযোগ ছাড়াও গোরক্ষা, লাভ জেহাদ, ধর্মান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানা ব্যাপারে সংখালঘু মানুষকে কোণঠাসা করা শুরু হবে। শিক্ষা আর চাকরিতে সংরক্ষণ নিয়ে দলিত-ওবিসি বনাম মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এমনিতেই বিপদের মুখে, কেন্দ্রে-রাজ্যে বিজেপি সরকার হলে তা প্রায় লোপ পাওয়ার অবস্থা হবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সংগঠন আর নেতৃত্বের যা হাল দেখা যাচ্ছে, তাতে রাজ্যের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সামনে সর্বদা নতজানু হয়ে থাকবেন। বৃহৎ পুঁজিনির্ভর অর্থনীতি আর উত্তর ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদ সেই নাবিক সিন্ধবাদের গল্পের বুড়োর মতো বাংলার ঘাড়ে চেপে বসবে।
অতএব এ বার যদি পালাবদল হয়, তা শুধু রাজনীতি নয়, বাংলার অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সব কিছুই আপাদমস্তক বদলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। হিন্দিতে যাকে বলা হয় হিন্দুরাষ্ট্র, বাংলায় তাকে বলা যায় হিন্দু জাতীয়তা— যার কল্পনায় কোনও বহুত্বের ধারণা নেই। তার মন্ত্র ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা’। এই হিন্দুরাষ্ট্রের দেহে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ লীন হয়ে যাবে কি না, তার পরীক্ষা হতে চলেছে এ বারের নির্বাচনে। সুতরাং, সাধু সাবধান!