বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪০ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর
@ ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত দিতে হয় ‘বকশিস’ নামের উৎকোচ, না দিলে চলে হুমকি-মারধোর
@ স্থানীয় এমপি, সিটি মেয়রসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ
@ হয়রানী বন্ধে পদক্ষেপ নেয়াসহ সেনা বাহিনী কর্তৃক পরিচালক নিয়োগ দাবি উঠছে
রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে অসুস্থ মাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বকশিস সিন্ডিকেট চক্রের হয়রানীর শিকার হয়েছেন এক চিকিৎসক। রোববার তিনি লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পরেই চুক্তিভিত্তিক দুই কর্মচারী ঝর্ণা বেগম ও মাসুদকে বরখাস্ত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত গঠন করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আমাদের প্রতিদিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরিফুল হাসান। তিনি জানান, চিকিৎসকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুই কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনা তদন্তে এবং এর নেপথ্যে আরও কেউ জড়িত আছে কি না তা জানতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হরিপদ সরকারকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মোস্তফা জামান চৌধুরী এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. আবুল হাসান। কমিটিকে পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে রংপুর নগরী ও জেলার আট উপজেলা ছাড়াও বিভাগের আট জেলার মানুষজন চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে আসছে। তবে এ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা নত্য দিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে রোগীর মৃত্যুর পরও কান্নায় দিশেহারা স্বজনদের গুনতে হয় ‘বকশিস’ নামের উৎকোচ। হাসপাতালটিতে বকশিস ছাড়া সেবা পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার কর্মচারী, দালাল এবং বিভিন্ন পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো বকশিস সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের কাছে রোগী ও স্বজনসহ সবাই যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে।
এছাড়াও বকশিস না পেলে রোগীর স্বজনদের উপর চড়াও হওয়া থেকে শুরু করে মারধরের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই। এনিয়ে অনেকই মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও চিকিৎসার স্বার্থে অনেকেই মুখ খুলতে নারাজ। তবে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটিতে সেনা বাহিনী কর্তৃক পরিচালক নিয়োগ দেয়ার দাবি করা হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, সেখানে দেখা যায় তিনজন কর্মচারী এসেছেন হাসপাতালের অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এ.বি.এম রাশেদুল আমীরের কাছ থেকে বকশিস নিতে। ওই তিনজন হাসপাতালের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। তারা বকশিস সিন্ডিকেটের সদস্য বলে জানা গেছে। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হন ওই চিকিৎসক । এঘটনার পরেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার রোগী হয়রানি প্রসঙ্গে রমেক হাসপাতালের পরিচালক ছাড়াও স্থানীয় সংসদ সদস্য, সিটি মেয়র, রমেক অধ্যক্ষ, জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই চিকিৎসক।
সচেতন মহল ও চিকিৎসা সেবা প্রার্থীরা বলছেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের কর্মচারী, দালাল এবং বিভিন্ন পরিচয়ে দিয়ে বকশিস সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা দাঁিপয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে হুমকি ও মারধোরের ঘটনা ঘটছে। টাকা ছাড়া কোন সেবা পাওয়া যায় না। যার উদাহরণ সম্প্রতি এক চিকিৎসক তার মায়ের চিকিৎসা নিতে এসে হয়রানীর শিকার হয়েছেন। হাসপাতালের একজন চিকিৎসক হয়েও যদি হয়রানির শিকার হতে হয়, সেটা অত্যান্ত দুঃখজনক। পীড়াদায়ক। এতেই সাধারণ মানুষের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয় করা যায়। এজন্য হাসপাতালটিতে সেনা বাহিনী কর্তৃক একজন পরিচালক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। এতে হাসপাতালটির শৃংঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আসবে। সাধারণ জনগণ হয়রানীর শিকার হবে না। সেবা পাবে।
লিখিত অভিযোগে চিকিৎসক এ.বি.এম রাশেদুল আমীর বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর তার মা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন স্বজনরা। জরুরি বিভাগে ভর্তির জন্য ২৫০ টাকা দাবি করা হয়। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মা পরিচয় জানতে পেরে তারা ৫০ টাকা ভর্তি বাবদ নেন। যদিও হাসপাতালে নির্ধারিত ভর্তি ফি ২৫ টাকা এবং সরকারি কর্মকর্তার মা এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসাবে ভর্তি ফি না নেওয়ার কথা।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ভর্তি পরবর্তী সিসিইউতে তার অসুস্থ মাকে নেওয়া হলে সেখানে জরুরি বিভাগে কর্মরত দুজন জোরপূর্বক তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছ থেকে ২০০ টাকা বকশিস নেন। এসময় তাদের আমার নাম পরিচয় এবং রোগী সম্পর্কে জানানো হলে তারা বলে ‘যে স্যারের মা হোক টাকা দিতে হবে’। পরবর্তীতে আমি রাতে আসার পর মায়ের শয্যা পাশে অবস্থানকালে সিসিইউতে কর্মরত ওয়ার্ড বয় পরিচয়ধারী মাসুদ আমার কাছে সরাসরি টাকা দাবি করে। এসময় আমি সেই কথাবার্তার কিছু মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করি।
রাশেদুল আমীর বলেন, এই ঘটনা আমার কাছে অত্যন্ত মানসিক পীড়াদায়ক এবং অপমানকর। যে প্রতিষ্ঠানে আমি সেবা দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি তা সত্যি দুঃখজনক। আমি নিজে হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা হয়েও যদি হয়রানির শিকার হই, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয় করা যায়।
এব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরীফুল হাসান বলেন, ঘটনাটি অত্যান্ত দুঃখজনক। চিকিৎসকের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জড়িত মাসুদ ও ঝর্ণা বেগম নামের দুই চুক্তি ভিক্তিক কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনার তদন্ত ও নেপথ্য কারণ জানতে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।