সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 2 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী,রাজশাহী:
রেল বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর রেলে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তার শতকরা ৯০ ভাগ সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রটির কারণে। এমন বাস্তবতায় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে ৮০ শতাংশ সিগন্যাল ব্যবস্থায় সেকেলে। এতে রেল চলাচলে ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে না ট্রেনের গতিও।পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ১ হাজার ৬৮৪ কিলোমিটার রেলপথের ২৫৫টি স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৩১টি স্টেশন আধুনিক সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং প্রতিস্থাপন হয়েছে। এরমধ্যে ৬৬টি স্টেশন ও স্টেশন সেকশনে কোনো ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ১৫৮টি স্টেশন ব্রিটিশ আমলের পুরোনো পদ্ধতির ম্যানুয়াল বা হ্যান্ডেল সিগন্যালে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এছাড়া ৮০ শতাংশ সিগন্যাল পয়েন্টের আয়ুকাল প্রায় অর্ধশত বছর আগেই শেষ হয়েছে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির নাম ‘সিগন্যাল ব্যবস্থা’! ফলে গতি পাচ্ছে না এ অঞ্চলের রেল চলাচল ব্যবস্থায়।
সূত্রে আরও জানা গেছে, পশ্চিমাঞ্চল রেলপথে আন্তঃদেশীয় মৈত্রী ও মিতালী এক্সপ্রেস বাদে ৫২টি আন্তঃনগর, ছয়টি লোকাল ও ৩১টি মেইল ট্রেন চলাচল করে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত চলাচল করে মালবাহী ট্রেনও। কিন্তু সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং প্রতিস্থাপনের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি।সপ্রতি ৬৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর সেকশনের স্টেশনগুলোর সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন এবং আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৭ মেয়াদে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে আরও ২০টি স্টেশন আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থার আওতায় আসবে।প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি করে নতুন ট্রেন চালু করছে রেলওয়ে। একইসঙ্গে বাড়ছে নতুন রেলপথ। কিন্তু সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকায়নে রেলের যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল রেল তা দেয়নি।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু আছে। এরমধ্যে সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাটি হচ্ছে রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। এ ব্যবস্থাটি পুরোপুরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত যেসব স্টেশনে বেশি ট্রেন চলাচল করে সেসব স্টেশনে এ ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া সিবিআই (কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং) সিগন্যাল, সিটিসি (সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল), পুরোনো আমলের মেকানিক্যাল ইন্টারলকড সিগন্যাল ব্যবস্থা। এ রকম সিগন্যালের জন্য লাইনের পাশে এক ধরনের তার ব্যবহার করা হয়, যা সংযুক্ত থাকে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত লিভারের সঙ্গে। এ লিভারে টান দিয়ে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার লাল-সবুজ বাতি ব্যবহার করে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ সিগন্যাল যে স্টেশনে ব্যবহার হয় সে স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগে স্টেশন মাস্টার লোকজন দিয়ে সিগন্যাল ঠিক করেন কোন লাইন দিয়ে ট্রেন যাবে।রেল বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রেন চলাচলে নিরাপত্তা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা, ট্রেন চলাচলের গতি বৃদ্ধি, সেকশনের ট্রেন চলাচলের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, অপারেশনাল সুবিধা বৃদ্ধি ও ট্রেনের ভ্রমণ সময় কমানোসহ রেলসেবা বৃদ্ধির জন্য রেলে সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। ট্রেনের সংখ্যা ও লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না।
তারা বলছেন, সিগন্যাল বিভাগে লোকবল সবচেয়ে কম। আর যে লোকবল রয়েছে তা অধিকাংশ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগকৃত এবং অদক্ষ। একারণে প্রতিবছর দুর্ঘটনা বাড়ছে।ঈশ্বরদী রেলওয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত লোকো মাস্টার (ট্রেনচালক) জাহিদুল আলম সনো বলেন, ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের প্রায় এক কিলোমিটার আগে আউটার সিগন্যাল থাকে। সে সিগন্যালে সবুজ ও হলুদ সংকেত থাকলে ট্রেন স্টেশনের পথে অগ্রসর হয়। এরপর স্টেশনে প্রবেশের ২০০ মিটারের মধ্যে হোম সিগন্যাল থাকে। সেখানে সবুজ সংকেত থাকলে ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করে। যদি আউটার সিগন্যালে লাল সংকেত থাকে তাহলে ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। সবুজ সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত ট্রেন স্টেশনের পথে অগ্রসর হতে পারে না। ট্রেন স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় স্ট্যাটার সিগন্যালের সংকেত দেখে ছাড়তে হয়।তিনি বলেন, রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা সব স্টেশনে আধুনিক না হওয়ায় আউটার সিগন্যালে ট্রেন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন ক্রসিং করার সময়ও বিলম্ব হয়। এছাড়া ট্রেন দ্রæতগতিতে চালানো সম্ভব হয় না। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রবিউল ইসলাম জানান, রেলের অধিকাংশ স্টেশনে ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়ালি সিগন্যাল ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। এখনো কিছু কিছু স্টেশনে বাঁশের মই ব্যবহার করে নির্ধারিত পিলারে লাল-সবুজ বাতি লাগিয়ে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরকম মান্ধাতার আমলের সিগন্যাল ব্যবস্থায় চরম ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলছে। ফলে মাঝে মধ্যেই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। সুশৃঙ্খল ও ঝুঁকিমুক্ত ট্রেন চলাচলের জন্য আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা খুবই জরুরি।