বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৪ অপরাহ্ন
Reading Time: 5 minutes
লেখক-রণেশ মৈত্র, পাবনা:
ইদানীং সম্ভবত: সকল প্রচারের গণমাধ্যমই আমাদের সরকারের জন্য এক পীড়াদায়ক মাধ্যমেই পরিণত হয়েছে। সরকার অহোরাত্র আমাদেরকে প্রথমত: কোভিড-১৯ জনিত বিশ^ব্যাপী উৎপাদন হ্রাস ও ইউক্রেনে-রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধজনিত কারণে আমদানী-রফতানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার প্রেক্ষিতে বিশ^ব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে কাহিনী অহরহ শুনাচ্ছেন বাংলাদেশে জ¦ালানীতেল ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন ও পেট্রোলের অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ জানাতে গিয়ে তা আজ আর ধোপে টিকছে না।
কোভিড-১৯ জনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলমান থাকা সত্বেও, বিশ^ বাজারে জ¦ালানী তেলের মূল্য যে হ্রাস পেতে শুরু করেছে-সে খবরটি তুলে ধরে সাংবাদিকেরা যখন গত ৭ আগষ্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রশ্ন করেন-এই খবরের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে জ¦ালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি স্থগিত রাখা হবে কি না মন্ত্রী মহোদয়েরা বলেন, কমে যাওয়া দামে তেল আসলেই আমরা জ¦ালানী তেলের দাম সমন্বয় করবো। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা ছিল, তাঁরা দ্রুততার সাথে মূল্যবৃদ্ধি স্থগিতের প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবেন। অথবা বলবেন, আমরা সরকারের তরফ থেকে দ্রুততার ভিত্তিতে কমদামী জ¦ালানী তেল বিশ^বাজার থেকে কিনে আনার বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি যাতে দেশের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে তার একটা সুরাহা হয়। না, এমন সৌভাগ্য এমন সৌভাগ্য নিয়ে এ যুগের বাঙালিরা ধরাধামে আসতে পারেন নি। জনগণের স্বার্থ রক্ষাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব এই বোধ আমাদের সরকার পোষণ করেন কদাচিতই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যা হোক, কবে বিশ^বাজার থেকে আমদানী কারকেরা কম দামে জ¦ালানী তেল আনবেন কবে তার দ্বারা জনগণ দুর্ভোগ মুক্ত হবেন-তা এই মুহুর্তে ধারণা করা যাচ্ছে না।
এবারে রেল ও লঞ্চভাড়া বৃদ্ধি
আগষ্টের দৈনিক পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ডিজেলের দাম ৪২.৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় এবার বাড়ছে লঞ্চ ও রেলের ভাড়া। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। এতে সারা দেশে দূরপাল্লার বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা এবং মহানগরে ৩৫ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে। এখন লঞ্চের ভাড়া দ্বিগুণ করতে চাইছে লঞ্চের মালিকপক্ষ।
অন্যদিকে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, ট্রেন ও বাসের ভাড়ার মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। ফলে ট্রেনের উপর বিশাল চাপের সৃষ্টি হবে। এতে করে ট্রেনের ওপর চাপ কমাতে ভাড়া বাড়াতে হতে পারে। যা হোক, লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মালিকদের প্রস্তাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শীঘ্রই সরকার ও লঞ্চ মালিকদের প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসবেন। প্রশ্ন অবশ্যই উত্থাপন করা যেতে পারে, যেহেতু বিশে^র বাজারে তেলের দাম ইতিমধ্যেই হ্রাস পেয়েছে এবং শীঘ্রই বাংলাদেশের বাজারেও এসে পৌঁছাচ্ছে, তাই ২/১ সপ্তাহের জন্য রেল ও লঞ্চের ভাড়া না বাড়ালে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? না, এভাবে ভাবতে সরকার রাজীন নন কারণ সম্ভবত: এই যে লঞ্চ মালিক, বাস মালিক প্রভৃতি সকলেই সরকার দলীয়। তাদের স্বার্থ তা যৌক্তিক বা অযৌক্তিক-যাই হোক না কেন-রক্ষা করতেই হবে। জনগণ বাধ্য হবে মেনে নিতে কারণ সংঘবদ্ধ এবং কার্য্যকর প্রতিবাদ বা আন্দোলনের শক্তি বিরোধী দলগুলির নেই।
জ¦ালানী তেলের দাম না বাড়ালেও চলতো সরকারি তথ্যই বলছে, জ¦ালানী তেলের দাম না বাড়ালেও সরকারের আদৌ কোন ক্ষতিকর কারণ ছিল না। কারণ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) বিগত আটক বছরে লাভ করেছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রীয় তেল বিপণনকারী সংস্থাটি গত হয় মাসে (ফেব্রুয়ারি-২২ থেকে জুলাই, ২২ পর্য্যন্ত) ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা লোকসান দেওয়ায় দেশে জ¦ালানী তেলের দাম ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। আর সবাই আমরা যে আমাদের দেশে কোন কিছুর দাম যদি কোনক্রমে একবার বাড়ে তা আর কোন দিন কোন কারণেই কমে না।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আর চলতি বছরের ৮ মে পর্যন্ত ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে সংস্থাটির। ট্যাক্স, ভ্যাট ও প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ থেকে প্রতি বছর বিপিসি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে হাজার হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে।
বাজেট উপস্থাপনের দিন, ৯ জুন প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রকাশনা, “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা”র তথ্য অনুযায়ী বিপিসি ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০ কোটি, ২০১৭ সালে ৮,৬৫৬ কোটি, ২০১৮ সালে ৫,৬৪৪ কোটি, ২০১৯ সালে ৪,৭৬৮ কোটি, ২০২০ সালে ৫,০৬৭ কোটি, ২০২১ সালে ৯,৫৫৯ কোটি ও ২০২২ সালে ২৩ মে পর্য্যন্ত ১,২৬৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে।
অপরপক্ষে বিপিসির বাজেট রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে ৯,৯৩২ কোটি ২০১৯ সালে ৮,৬৬৮ কোটি, ২০২০ কোটি ১৪,১২৩ কোটি, ২০২১ সালে ১৫,০৪৬ কোটি ও ২০২২ ালে ৮,৫৪০ কোটি টাকা সরকারকে ভ্যাট, ট্যাক্স ও লভ্যাংশ বাবদ জমা দিয়েছে সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই জ¦ালানী তেলের দাম না বাড়ানোর পথ ছিল। টানা ৮ বছর ৪৮,০০০ কোটি টাকা লাভ করার পর ৬ মাসে ৮,০০০ কোটি টাকা লোকসান দেওয়ায় দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যখন বিপিসি হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে তখনও তো দাম কমানো হয় নি। মুনাফার টাকা দিয়ে এখন কিছুদিন দিব্যি ভর্তুকী দেওয়া যেত জনগণের দুর্ভোগ না বাড়ানোর লক্ষ্যে। বিশ^ বাজারে জ¦ালানীর দাম ক্রমাগত কমছে। দ্রুততার সাথে দাম না বাড়িয়ে কিছুদিন পর্য্যবেক্ষণ করা যেত। আবার ব্যাংকে বিপিসির যে ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে তা দিয়েও ভর্তুকী দেওয়া যেত। আবার সরকার যদি বিশেষ প্রয়োজনে ২/১ বছর বিপিসির কাছ থেকে ভ্যাট, ট্যাক্স, লভ্যাংশ নেওয়া স্থগিত রাখতেন যে ক্ষেত্রেও ওই টাকা দিব্যি বিপিসি ভর্তুকী দিতে পারতো।
বিপিসির লভ্যাংশ থেকে গত সাত বছরে সরকার ১৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া এক লিটার ডিজেল থেকেই সরকার ১৯ থেকে ২০ টাকা ট্যাক্স-ভ্যাট আদায় করে থাকে। বছরে জ¦ালানী তেল থেকে সরকার ৮/৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। ট্যাক্স-ভ্যাট হিসেবে গত সাত বছরে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বিপিসি। বিপিসির তথ্যানুসারে ২০১৮ অর্থবছর থেকে সংস্থাটি শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬,৩০৯ কোটি টাকা দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুসারে, সব খরচ বাদে বিভিন্ন ব্যাংকে ৩২,০০০ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে বিপিসির। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপাপর ভিশনের তথ্য অনুযায়ী বিপিসির তিনটি বিতরণকারী কোম্পানী, পদ্মা অয়েল কোম্পনী ( মেঘনা কোম্পানীর ১৩,০০০ কোটি টাকার বেশী) ব্যাংক আমানত রয়েছে।
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করেই বলছেন, গত আট বছরে (২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২) বিপিসি ৪৮,১২২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে, জ¦ালানী তেলের দাম না বাড়িয়ে দিব্যি সেই টাকা থেকেই ভর্তুকী দেওয়া যেত।
ভোজ্য তেলের দাম বাড়াতে নতুন ফন্দী দেশের সবগুলি জাতীয় দৈনিক বিগত ৮ আগষ্ট প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রতিবেদন জানিয়েছে, বিশ^ বাজারে গত চার মাসের ব্যবধানে টন প্রতি অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম কমেছে ৯০৫ ডলার। গত কয়েক মাসের টানা দরপতনের কারণে একই সময়ের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম কমেছে ৪৪৪ ডলার। গত কয়েক মাসের টানা দরপতনের কারণে গত ২১ জুলাই দেশের বাজারে সয়াবিন তেলে দাম লিটারে ১৪ টাকা কমানো হয়। তখন বিশ^বাজারে যে দাম ছিল এখন তার চেয়েও অনেক কমেছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষ অপেক্ষায় আছে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম আর এক দফা কমানোর খবর পেতে। কিন্তু গত ৭ আগষ্ট জানাগেছে, মিল মালিক ও আমদানীকারকেরা প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশ^ বাজারে যেখানে ভোজ্য তেলের দাম অর্ধেক নেমে গেছে সেখানে দেশের বাজারে এই দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে হঠকারিতা বলে উল্লেখ করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ভোজ্য তেলের বিশ^বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ^বাজারে গত মার্চ মাসে প্রতি টন অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল ১৭৭৬.৯৬ ডলার। এর পর এপ্রিলে এসে আরও কমে হয় ১,৬৮২.৭৪ ডলার। মে মাসে কিছুটা বেড়ে হয় ১,৭১৬.৯২ ডলার। জুনে কমে এসে দাঁড়ায় ১,৫০১.৯২ ডলারে। জুলাই এ আরও কমে প্রতি টন অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম হয় ১,৪৪৫.৬৪ ডলার।
একইভাবে গত মার্চে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বিশ^ বাজারে ছিল ১,৯৫৬.৮৮ ডলার; এপ্রিলে কমে দাঁড়ায় ১,৯৪৭.৫১ ডলারে; মে মাসে কিছুটা বেড়ে ১,৯৬২.৮৮ ডলারে দাঁড়ায়; জুনে তা কমে দাঁড়ায় ১,৭৫২.৭৬ ডলারে; জুলাই এ দাম আরও কমে দাঁড়ায় ১,৭১৬.৭৬ ডলারে। মূল্যহ্রাস বিশ^ বাজারে আজও অব্যাহত।
এহেন পরিস্থিতির মধ্যে দেশীয় আমদানীকারক ও উৎপাদকেরা ভোজ্যতেলের দাম হঠাৎ করে পুনরায় বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছেন তা কোন বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ডলার ও বাংলাদেশী মুদ্রার বিনিময় হার হালে যে পর্য্যায়ে এসেছে সেটাকেই অজুহাত হিসেবে আমদানীকারক ও উৎপাদকেরা তুলে ধরছেন কিন্তু মুদ্রার বিনিময় হার যখন বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল তখন কি তঁরা ভোজ্য তেলের দাম কমানোর প্রস্তাব করেছিলেন।
আসলে বাংলাদেশে জনগণের স্বার্থ সর্বাত্মকভাবে আজ বিপদাপন্ন। কাঁচামরিচের দাম ২০০/৩০০ টাকায় উঠলেও কারও নড়ন চড়ন দেখা যায় না। চালের মওসুম হওয়া সত্বেও চালের দাম ক্রমান্বয়ে হু হু করে বেড়েই চলেছে। সামান্য বৃষ্টির অজুহাতে শাক-সবজি তরিতরকারির দাম বাড়ছিল। সবশেষে জ¦ালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনিত কারণে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়াতে সবজীর মূল্যই শুধু নয় মাছ, মাংস, ডিম ও অপর সকল আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়তেই থাকবে।
সরকারকে এমতাবস্থায় বলি, যানবাহন, পরিবহন, রেল, লঞ্চ বা নিত্যপণ্যের বাজার যাই বলুন বিষয়টা কিন্তু দ্বিপক্ষীয় নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র সরকার ও ব্যবসায়ীদের নয়। এক্ষেত্রে বিষয়টি সর্বাত্মকভাবেই ত্রিপক্ষীয়। অর্থাৎ ক্রেতাসাধারণ তৃতীয় পক্ষ কিন্তু তারাই হলেন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। তাই তাঁদের মতামত না নিয়ে কোন পন্যেরই মূল্য বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এ বিষয়গুলির কদাপি সংসদে আলোচিত হয় না। তাই তীব্র গণ-আন্দোলন ছাড়া এই সংকটের সমাধান নেই।
লেখক-রণেশ মৈত্র, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত