শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০১ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:
রাজশাহীতে থামছেই না কৃষি জমিতে পুকুর খনন। উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকদের ম্যানেজ করে চলছে এসব পুকুর খনন। অভিযোগ রয়েছে এমপি ও ক্ষমতাশীন দলের নেতাদের ছত্রছাঁয়ায় খনন করা হচ্ছে কৃষি জমিতে পুকুর। পুকুর খননের বিষয়ে স্থানীয় কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা এসিল্যান্ডের কাছে অভিযোগ দিলেও নামমাত্র অভিযান চালিয়ে তারা দায়িত্ব শেষ করছেন। লোক দেখানো অভিযান মূলত পুকুর খননকারীদের কাছে ভেড়ানোর কৌশল বলেও মনে করছেন কৃষকরা। যদিও উপজেলা প্রশাসন বলছে, অভিযোগ পেলে তারা অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করছেন। আর স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, খোদ উপজেলা প্রশাসনের ইন্ধনেই কৃষি জমিতে পুকুর খনন চলছে। তারা টাকার বিনিময়ে পুকুর খননকারীদের সহযোগিতা করছেন। কৃষকদের ভাষায়, জনপ্রতিনিধি, এমপি, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের মদদে কৃষি জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে। আর রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় রাজশাহীতে বন্ধ হচ্ছে না পুকুর খনন এমন মন্তব্য করেন কৃষকরা।
জানা গেছে, প্রতিবিঘা কৃষি জমি বছরে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে লিজ নিচ্ছে পুকুর খননকারীরা। এরপর তারা লিজ দিচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা বিঘা। প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে খনন করা হচ্ছে পুকুর। দেখা গেছে, একশ বিঘা কৃষি জমিতে একটি পুকুর খনন করা হলে আশপাশের তিন থেকে চারশ বিঘা জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে। পুকুর খননের জন্য রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত কি পরিমান কৃষি জমি পরিত্যক্ত হয়েছে তার হিসাব দিতে পারছে না কৃষি বিভাগ। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত কৃষি জমিতে পুকুর খনন করায় রাজশাহীতে প্রায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি পরিত্যাক্তের খাতায় উঠেছে। পুকুর খননের জন্য কৃষি অফিস দোষারোপ করছে উপজেলা প্রশাসনকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলার আড়ইলের বিলে প্রায় একশ’ বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন চলছে। এই পুকুরটি খনন করছে বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহŸায়ক হোসেল রানা। পুকুর খনন শুরুর দিকে স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সেখানে অভিযান চালায়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় যুকুর খননকারীদের ভেকু মেশিনসহ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। কিন্তু পরে পুকুর খননকারী সোহেল উপজেলা প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও দুর্গাপুর পৌর এলাকার বাসাইল ন্যাংড়ার বিলে পুকুর খনন করছেন ওই এলাকার মোতালেক ও বেলাল নামে দুই ব্যক্তি। এই পুকুরেও অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করা হয়। পুঠিয়ার কাচুপাড়ায় পুকুর খনন করছে তাহেরপুরের জাহিদ নামে এক ব্যক্তি। এখন প্রশ্ন হলো অভিযান চলছে, জেল জরিমানা করা হচ্ছে, পুকুর খননে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। তাহলে কি করে পুকুর খনন হচ্ছে বা পুকুর খননের কাজ চলছে প্রশ্ন এলাকাবাসীর।
জানা গেছে, কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালাতে গেলে আগেই পুকুর খননকারীদের বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়। প্রশাসন পুকুরে গিয়ে নামমাত্র জরিমানা করেন। অথবা পুকুর খনন করা মেশিনের ব্যাটারি জব্দ করা হয়। পরে সেই ব্যাটারি উপজেলা প্রশাসনের কাছে নিতে গিয়ে দেনদরবার করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পুকুর খনন বৈধ করা হয়। উপজেলা প্রশাসনকে টাকা দিলে পুকুর খনন আর বন্ধ থাকে না। পুকুর খননকারী বেলাল জানান, তারা দুর্গাপুর পৌর এলাকার বাসাইল ন্যাংড়ার বিলে পুকুর খনন করছেন। প্রথম দিকে স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিযান চালিয়ে তাকে এক মাসের জেল দেন। জব্দ করা হয় পুকুর খনন করা মেশিনের ব্যাটারি। তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসের বদলতে ১৬দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন। পরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কৃঞ্চচন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে আবার কাজ শুরু করেন। টাকা দিয়ে তিনি এখন দেদার্সে পুকুর খনন করছেন। তিনি বলেন, এই পুকুর খনন করতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসনের প্রায় সবাইকে টাকা দিতে হয়েছে।
পুকুর খননকারী তাহেরপুর পৌর সভার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা জানান, দুর্গাপুর আড়ইল বিলে পুকুর খনন শুরুর দিকে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়েছিল। পরে উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তিনি বর্তমানে পুকুর খনন অব্যাহত রেখেছেন। শুধু উপজেলা প্রশাসনই নয়, স্থানীয় নেতা, ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদেরও তিনি মোটা অংকের টাকা দিয়ে কৃষি জমিতে পুকুর খননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সরোজমিনে দেখা গেছে, দুর্গাপুর আড়ইল বিলে প্রায় একশ’র বেশি বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন যুবলীগ নেতা সোহেল রানা। এই পুকুর খনন করা হলে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। একশ বিঘা কৃষি জমিতে পুকুর খননের কারণে আশপাশে তিন থেকে চারশ বিঘা কৃষি জমি পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এরমধ্যে বেশ কিছু জমিতে সেচের অভাবে পরিত্যক্ত হবে, আর বাকি জমিগুলোতে জলাবদ্ধায় নিমজ্জিত থাকবে।
এ ব্যাপারে দুর্গাপুর ২নং কিশমত গণকৈড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন- আমি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তবে পুকুর খননকারীরা আপনাকে টাকা দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ ব্যাপার দুর্গাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কৃঞ্চচন্দ্র বলেন, আমি অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। অভিযান চালানোর পরও কেনো বন্ধ হচ্ছে না পুকুর খনন? এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, সেটি আমি জানি না। টাকা নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।