admin
- ৪ মে, ২০২৩ / ১০৩ Time View
Reading Time: 4 minutes
প্রকাশ্যে, থানার সামনে, দিনেদুপুরে রিফাতকে হত্যা করা হয়েছিলো, কোনো সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা থানা থেকেও কেউ উঁকি মেরে দেখে নি! এহেন দৃশ্যের দেখা মেলে বিশেষ করে ১৮শ শতকের পশ্চিমা সভ্যতা উপর ভিত্তি করে তৈরি করা কোনো ওয়েষ্টার্ণ ছবিতে। তাছাড়া এমন ঘটনা কোনো আউট’ল এরিয়াতেই হয়তো ঘটা সম্ভব হয় কিন্তু বরগুনা তো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেশের আইনের আওতাধীনে একটি জেলাই!
রিফাতকে থানার গেটে কুপিয়ে হত্যার পরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় একে একে বের করে নিয়ে আসতে থাকে অন্তরালে থাকা বিভিন্ন বিষয়সমূহ, বেরিয়ে আসে চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর ভূমিকা, বেরিয়ে আসে এমপি পুত্র সুনামের কুপ্রবৃত্তি কথা, প্রমাণিত হতে থাকে হত্যাকারী গ্যাং-এর প্রধান নয়ন বন্ড বরগুনার মাদক আর আন্ডার-ওয়ার্ল্ডের কেবলই একটা বোড়ে তথা সৈন্য। তারপর হঠাৎ ক্রসফায়ারে মারা যায় নয়ন বন্ড, আর পাল্টে যায় পুরো ঘটনাপ্রবাহ! অবশেষে মিন্নি এখন কনডেমসেলে বসে দন্ড সুত্রে পাওয়া মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে।
বরগুনার প্রকৃত পরিস্থিতি দেখলে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, বরগুনাতে আসলে কি চলে? উত্তর দিতে গেলে শুরুতেই বলতে হবে, ‘বরগুনা কোনো রাম রাজত্ব নয় বটে কিন্তু কোনো ভাবেই বরগুনা সম্ভু বাবুর রাজত্ব নয়, একথা বললেও ভুল বলা হবে’।
কিছুদিন আগের ছাত্রলীগ পরিচয়ে সুনাম লীগের গুন্ডাপান্ডা, বদমাইশদের উপর বাধ্য হয়ে লাঠি চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তার শেষ পরিণতিও যা হেয়েছে তাও বরগুনা যে সম্ভু বাবু রাজত্বই যেনো এবং তারই প্রমাণ করে। এবার আবার বরগুনার রেকর্ড-ব্রেক নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটেছে রাজনীতির জেরেই। প্রশ্ন এসে যায়, হত্যাকারীরা বরগুনায় কার অনুসারী? আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও ঠান্ডারা আসলে কার গোলামী করে? একথার উত্তর আরেকদিন হবে, আজ জেনে নেই ঠান্ডা মিয়া, মোতাহার মৃধা, কুদ্দুসরা আসলেই কতোটা পিচাশ প্রকৃতির এবং ভেবে ঠিক করুন এমন পিচাশদের রক্তধারার গতিবিধি এখনই থামিয়ে দেয়া উচিৎ কিনা।
গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা আওয়ামী নেতা শফিকুল ইসলাম পনু আকনের নিজবাড়িতে হায়নার মতো দল বেঁধে ঢুকে স্ত্রী সন্তানদের চোখের সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও বুকে টেঁটা মেরে হত্যা করে বুকের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করে বীরদর্পে চলে যায়! পনু বরগুনা সদর উপজেলার পাকুরগাছিয়া গ্রামের মৃত মোসলেম আলী আকনের ছেলে। সাবেক এই ইউপি সদস্য আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বরগুনার আবাল বৃদ্ধ ভনিতাদের পরিচিত নাম ‘ঠান্ডা বাহিনী’ এ হত্যাকান্ডের সময় মৃত পনু পানি চাইলে নরপশু মোতাহার মৃধা তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়! বীভৎসভাবে হত্যার পর লাশের বুকের ওপর চড়ে নারকীয় উল্লাস করে দানবের সর্বগ্রাসী তৃপ্তিতে!!
স্থানীয়রা জানান, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘ঠান্ডা গ্রুপ’ ও ‘পনু গ্রুপের’ মধ্যে চলমান বিরোধের জেরে এক সংঘর্ষের পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
এদিকে চোখের সামনে বাবার নির্মম মৃত্যু দেখে, মর্গের লাশ কাটা ঘরে বাবার মুখটা শেষ দেখাটা দেখে চলমান এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে যায় পনু আকনের মেয়ে সানজিদা ইসলাম রিয়া (১৭)। থানার সামনে রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে রিফাতকে হত্যা করার যে দৃশ্যটি সারা বাংলার মানুষ দেখেছে এঘটনা সে দৃশ্যকেও হার মানিয়েছে।
আওয়ামী নেতা শফিকুল ইসলাম পনুকে যে নারকীয় তাণ্ডবে হত্যা করা হয় তার বর্ণনা দিতে নিহতের স্ত্রী ছবি আক্তার বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মোতাহার মৃধা, কুদ্দুস ও ঠান্ডা বাহিনীর ২০-২৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী রামদা, টেঁটা, তিনকাঁটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার স্বামীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
সন্ত্রাসীরা আমার স্বামী পনু আকনকে বুকে-পিঠে, হাতে-পায়ে, কপালে, মাথায় কমপক্ষে ৫০টি কোপ দেয়। টেঁটা মারে বুকের ওপর। আমরা বাধা দিলে আমাকে ও আমার ছেলেকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে।
হত্যা করে তার লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দিলে সন্ত্রাসীরা আমাদের পেটাতে থাকে। আমাদের চিৎকারে লোকজন এলে লাশ নিতে পারেনি। পুলিশ আমার স্বামীর লাশ উদ্ধার করে রাত সাড়ে ১০টায় বরগুনা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সেখানে চিকিৎসক তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করেন।’
নিহত পনুর স্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার স্বামী পানি খেতে চেয়েছিল। তখন মোতাহার মৃধা তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে হত্যা করে বুকের ওপর উঠে উল্লাস করে। রাতে আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাইনি। সে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল।’
নিহত পনু আকনের ছেলে হৃদয় বলেন, ‘আমার ও আমার মায়ের চোখের সামনে বাবাকে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের বাধার কারণে নিতে পারেনি।’
বুধবার বিকালে জানাজা শেষে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়েছে পনু আকনকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০২১ সালে আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩ নম্বর ওয়ার্ড পাকুরগাছিয়ায় পনু আকন ও মোতাহার মৃধা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আর সেখান থেকেই এই শক্রতার সুত্রপাত।
স্থানীয়দের কাছ থেকে আরও জানা যায়, নির্বাচনের দুই মাস আগে একবার এই মোতাহার মৃধা ও আকাইদ হোসেন ঠান্ডারা মারধর করে পনু আকনের হাত-পা ভেঙে দেন। এছাড়া ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ওই গ্রুপ পনু আকনকে আয়লা বাজারে জনসম্মুখে কুপিয়ে জখম করেছে। এ দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মামলায় কুদ্দুস খাঁ, মোতাহার মৃধা ও আকাইদ হোসেন ঠান্ডাসহ আরও কয়েকজনকে আসামিরা এখনও এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলে তাদের নেতার বলে!
উল্লেখ্য যে ২০২১ সালের ২১ জুনের সেই নির্বাচনে মোতাহার মৃধা মেম্বার নির্বাচিত হন। আরও গতিশীল হয় তাদের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। তারই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার রাতে মোতাহার মৃধা, কুদ্দুস, ঠান্ডারা এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবদুল হালিম জানান, খবর পেয়ে পুলিশের কয়েকটি টিম পাঠানো হয়েছে ঘটনাস্থলে। আহতদের উদ্ধারবাদ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে অভিযান চলমান রেখে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়ে।
বরগুনা থানার ওসি আলী আহম্মদ জানান, এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত শেষে তারা মামলা করবেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উভয় পক্ষের ১০ জনকে থানায় আনা হয়েছে।
প্রিম পাঠক, সকাল বেলায় বাবার মুখটা শেষ বারের মতো মর্গের লাশ কাটা ঘরে দেখে গিয়ে সানজিদা নামের কিশোরী মেয়েটি তার এসএসসি পরীক্ষা কেমন কি দিয়েছে তা জানার সাধ আপনাদের কারোর যে নাই, তা নাই বা থাক কিন্তু মেয়েটার পরীক্ষা যেনো ভালো হয় এই দোয়াটুকু করবেন, আপনাদের কাছে বিশেষ ভাবে মিনতি জানাই। আর বলতে চাই, ‘ভালো নেই, কিচ্ছু ভালো লাগে না সবকিছু থাকতেও! বারবার মনে হয় মেয়েটা যখন তার বাবাকে ওভাবে হত্যা করতে দেখছিলো তখন তার বুকের ভিতরে কেমন করছিলো? আমাদের প্রধানমন্ত্রী আজও তাঁর মৃত ভাই রাসেলটার জন্য কাঁদেন, পনুর মেয়েটা কি শেখ হাসিনার মতোই অধিকার রাখে?
এছাড়াও এই হত্যাযজ্ঞের পর বারবার মনে হচ্ছিলো মিন্নির কথা। বরগুনার মিন্নি নামের এক যুবতী তার চোখের সামনে সদ্যযুবা স্বামীকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে দেখে শত চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি, থানার দরজার সামনে অথচ কেউ এক পা এগিয়ে আসেনি! অতঃপর সেই যুবতী একাই তার স্বামীর লাশ রিক্সায় উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু ডাক্তার তার স্বামী রিফাতকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মিন্নি এখন কনডেমসেলে মৃত্যুর দিন গুনছে স্বামী রিফাত হত্যার দায়ে। মিন্নির মতো মৃত পনুর স্ত্রী ছবিও দেখলো তার চোখের সামনে স্বামীটাকে…
“হে আমার আল্লাহ মালিক, এখানে আমরা সবাই বাঙ্গালী। মুক্তি চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। গাড়ী-বাড়ী, ব্যাংক ব্যালেন্স আর প্রতিপত্তি কিচ্ছু চাই না মালিক, শুধু সবাই মিলে ভালো থাকতে চাই। পথ করে দিন যেপথে চললে আমাদের সবার সন্তানরাও থাকবে দুধেভাতে। এ হত্যাযজ্ঞ আমরা আর দেখতে চাই না মালিক, আমাদের জ্ঞমা করে দিন, আমরা সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই পারছি না…., আমিন।”
মতামতের জন্য সম্পাদক দাহি নই।