বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
শিক্ষামন্ত্রী সস্প্রতি বলেছেন, শীঘ্রই দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খুলে দেওয়া হবে এবং এ ব্যাপারে সরকারের সকল প্রস্তুতি রয়ছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে দুটি শর্তের উল্লেখ করেছেন। এক. করোনার সংক্রমণ হার শতকরা ৫ ভাগে নেমে আসা এবং দুই. শতভাগ শিক্ষার্থীর টিকাদান সম্পন্ন হওয়া। এই লক্ষ্যেই টিকা গ্রহণকারীর বয়স কমিয়ে ১৮ বছরে নামানো হয়েছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। আজ দীর্ঘ দেড় বছর যাবত করোনা মহামারি জনিত কারণে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ না রেখেও যেমন উপায় ছিল না তেমনই আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার বিকল্প এবং কার্য্যকর পথ খুঁজে বের করতে সরকার নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা সকল পর্য্যায়েই সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ ক্ষতি কিছুতেই পূরণ হবার নয়।
ভাবতেই খারাপ লাগে যে দুটি বছর যাবত কোন নতুন শিক্ষার্তী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এভাবে তাদের জীবন থেকে-কর্মজীবনে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ থেকে পিছিয়ে পড়ছে যার অভিঘাতে তাদের পরবর্তী জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর যে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এই দু’বছর লেখাপড়া থেকে বঞ্জিত হয়ে বাইরে আড্ডা মেরে সময় পার করেছেন-তাঁদের অবস্থাও অনুরূপ। আবার যাঁরা অনলাইন পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছেন বাড়ী বসে তাঁরা প্রায় সকলেই বই খুলে পরীক্ষা দেওয়ার ফলে তাদের প্রকৃত ফল জানা যায় নি। প্রায় সকলেই ভাল ভাল নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে যা স্বাভাবিক সময়ে সম্ভব হতো না।
যা হোক, যা হবার তাতো ঘটেই গেছে। আনন্দের খবর হলো ইতোমধ্যে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ও হার এবং করোনা সংক্রমণের হার আনুপাতিক হিসেবে যথেষ্ট কমে এসেছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাই শুধুন নয়-তা স্বরান্বিত বা দ্রæততর গতিসম্পন্ন করার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
কেন সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা ও হার কমে আসছে? না, এটা কোন দৈব ঘটনা নয়। বিজ্ঞান এ কাজে শতভাগ সুযোগ করে দেওয়াতেই তা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকেরা করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার করে তা উৎপাদন বাজারজাতকরণ ও ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় এবং বাংলাদেশে ডবল ডোজ ভ্যাকসিন প্রদানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কমে এসেছে তাই এই শুভ প্রক্রিয়া শুধুমাত্র অব্যাহত রাখাই নয়-তা আরও বেশী জোরদার এবং আরও অনেক বেশী গতিবেগ সম্পন্ন হওয়া দরকার। সরকারি সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী সরকারের হাতে এখন যথেষ্ট টিকা সওজুদ আছে এবং ভারত চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন আসবে শীঘ্রই। সুতরাং গণহারে টিকা প্রদান পুনরায় সুরু করার প্রস্তাব রাখছি। এক্ষেত্রে এমনা করা যায় কি না যে গ্রামাঞ্চলে যখন কোন ইউনিয়নে টিকাদান কার্য্যক্রম শুরু করা হবে তখন প্রতিদিন নির্দিষ্ট কয়েকটি করে গ্রামের মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এক সাথে ইউনিয়নের সকল গ্রামের মানুষ জড়ো হলে শৃংখলা রক্ষা করা কঠিন এবং তা কয়েক সপ্তাহ আগে যখন গণটিকা দেওয়া হচ্ছিল তখন দেখা গেছেঠ।
শহরেও ওয়ার্ড ভিত্তিতে একই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। নির্দিষ্ট দুটি করে ওয়ার্ডে টিকাদান করলে সেখানেও সুশৃংখলভাবে টিকাদান সম্পন্ন হতে পারে। তবে দুটি শর্ত। এক. রেজিষ্ট্রেশন অন দ্য স্পট ব্যবস্থা চালু করা দরকার; দুই. টিকাদানের বুথের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয় পত্র দিখেই যেন ভ্যাকসিন দেওয়া হয় এবং কমবয়সী যারা এখনও জাতীয় পরিচয় পত্র পায় নি-তাদের জন্য ভিন্ন কোন সহজ ও গ্রহণযোগ্য এবং কার্য্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক।
এবারে বয়স সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। সরকার টিকা গ্রহণকারিদের বয়স সীমা ১৮ করেছেন। এর ফলে এইচ.এস.সি. থেকে উপরের শিক্ষার্থীরা টিকা নিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে যে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং যারা স্কুল খোলার পরে নানা শ্রেণীতে নানা পর্য্যায়ে ভর্তি হবে তাদের তো টিকা দানের আওয়তায় আনা যাবে না। তা হলে হাজার হাজার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় কি আরও অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখা হবে? তা যদি হয় তবে তা হবে আত্মঘাতি। শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে স্তরভেদে সামান্যতম বৈষম্য করা নেহায়তেই অনুচিত ।
তাই শিশু-কিশোরদের দ্রæত শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে আনা এবং নতুনদের ভর্তির সুযোগ দ্রæত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে টিকা গ্রহণকারীর বয়স সীমা ছয় বছরে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। এতে টিকাদানের ব্যবস্থাপনায় চাপ পড়লেও সে চাপ মোকাবিলা করে পূর্ণাঙ্গভাবে শিক্ষাঙ্গনগুলিতে শিক্ষার্থী শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের পদচারণায় আবার মুখরিত করে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে আমি শুধুমাত্র টিকা গ্রহণের বয়স ছয় বছরে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই বলছি না বরং আরও বলছি, এখনই ছয় থেকে বার বছরের শিশুদেরকে, তারপরে বার থেকে ২০ বছরের তরুণ-তরুণীদেরকে এবং অত:পর ২০ থেকে ৪০ বছর বয়স্ক নারী-পুরুষকে টিকাদান করা হোক। অব্যশই কম বয়সীদের এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
আমি এই নিবন্ধের মাঝামাঝিতে গণহারে টিকাদান পুনরায় শুরু করতে সুপালিশ করেছি। এখন করলাম হয় থেকে বার, বার থেকে ২০ এবং অত:পর ২০ থেকে ৪০ বছরের নারী পুরুষকে অগ্রাধিকার দিতে। এই প্রস্তাব একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক এমনটা ভাবা অনুচিত হবে। কারণ একেও গণহারে টিকাদান বলে বিবেচনা করা উচিত।
বিষয়টি আরও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ থাকায় শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ বন্ধ থাকছে তাই নয় এর ফলে বেশ কিছু সামাজিক সংকটেরও তৈরী হচ্ছে। যেমন লেখাপড়ার সুযোগ বন্ধ-তাই বহু অভিভাবক কম বয়সী মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন ফলে বাল্য বিবাহ, অকাল মাতৃত্ব জনিত সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। শিশু-কিশোর তরুণ-তরুণীদেরকে দিন রাত্রির বেশীর ভাগ সময় নিজ নিজ বাড়ীতে আবদ্ধ থাকার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর পরিণতিতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে একটা বড় ধরণের সংকটের মধ্যে পড়তে হতে পারে।
আবার অপ্রত্যক্ষ সংকটও সৃষ্টি হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক। স্কুল কলেজ তো শুধুমাত্র আগের মত শহরেই সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয়, গ্রামাঞ্চলেও অসংখ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের যানবাহন যথা বাস, স্কুটার, রিক্সা প্রভৃতিও যাত্রী অভাবে দেড় বছর যাবত অর্থকষ্টে ভুগছিল তারও অনেকটা সুরাহা হবে। পথ ঘাট শিক্ষাঙ্গনে আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে।
তবে শুধুমাত্র টিকাদানই নয়। নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিটি রুম এবং আঙিনা জীবানুমুক্ত করার জন্য স্প্রে, মাস্ক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে-অর্থাৎ স্বাস্থ্যবিধি পূরাপূরি মেনে ক্লাস পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক-রণেশ মৈত্র
সভাপতি মÐলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ