শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০১ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 2 minutes
এইচএম মোকাদ্দেস, সিরাজগঞ্জ :
সিরাজগঞ্জে বসেছে ঐতিহ্যবাহী তিন’শ বছরের দই মেলা। দই আবহমান সময়কাল ধরে বাঙালির জীবনের প্রতিদিনের খাবার,ভোজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ , পেটরোগার পথ্য, পেটুকের ভালোবাসা। ভালো নাম্বারের আশায় পরীক্ষা দিতে যাবার আগে কপালে দইয়ের ফোঁটা, ভাইফোঁটায় আয়ুবৃদ্ধি কামনায় কপালে দইয়ের ফোঁটা, বিজয়া দশমীর শেষে সাংসারিক সুখ সমৃদ্ধির প্রার্থনায় দরজায় দইয়ের ফোঁটা। এ সবই ঘটে দই মেলাকে ঘিরে বাঙালি রসনায় দইয়ের জুড়ি নেই । শেষ পাতে দই হলে তো কথাই নেই। এ ছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজেও দই পরিবেশন করা হয়ে থাকে। দই থেকেও তৈরি হয় নানা পদ। এসবকে ঘিরেই প্রতি বছরই মাঘ মাসের শেষদিন শ্রী পঞ্চমীর দিনে সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে ও তাড়াশের জমিদার বাড়ির সম্মুখে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে আগেরদিন রাত থেকে দই মেলা বসে। মেলায় বগুড়া, পাবনা, নাটোর থেকে ঘোষেরা দই এনে পসরা সাজিয়ে বসিয়ে বিকিকিনি করেন। প্রতি কেজি দই বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। দইয়ের মেলায় আসা এ অঞ্চলের দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও ভিন্নতা রয়েছে। যেমন- ক্ষীরসা দই, শাহী দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুরী দই এ রকম হরেক নামে দামের হেরফেরে বিক্রি হয় দই। বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জের রাজাপুর, চান্দাইকোনা, শ্রীপুর, তাড়াশের দই প্রচুর বেচাকেনা হয়। তবে এবার দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে মেলায় দই বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। মেলায় দই বিক্রি করতে আসা বগুড়ার শেরপুরের দই বিক্রিতা নিমাই ঘোষ জানান,প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মেলায় ৪০ মন দই নিয়ে এসেছি। বিক্রি নাই বললেই চলে। মেলায় দই কিনতে আসা তাড়াশ পৌর এলাকার আব্দুল জলিল বলেন, মেলা উপলক্ষে দই,চিড়া মুড়ি মুড়কি কিনে থাকি। কিন্তু সবগুলোর দইয়ের দাম বেশি চাচ্ছে।আগে সরার (দইয়ের পাত্র) আকার ছিল বেশ বড় এখন দেখছি আকারে অনেক ছোট। একই দই গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। মেলায় দই বিক্রি করতে আশা আনন্দ ঘোষের সাথে কথা বলে জানাযায়, দুধের দাম, জ্বালানী, শ্রমিক খরচ, দই পাত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে। তবে মেলা এক দিনব্যাপী হলেও চাহিদা থাকার কারণে কোনো ঘোষের দই অবিক্রিত থাকে না। হাড়াজ্বালানি গরমে চিঁড়া, মুড়ি, খই, দই, আম, কলা, দুধ, ক্ষীর এতেই যা একটু রস, মিষ্টত্ব আর পরিতৃপ্তি। ব্যবসায়ীদের দাবি, দুধ,চিনি,ও জ্বালানির দাম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সরা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।অন্যান্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে বেড়েছে দুধ ও টক দইয়ের দাম। ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের তাড়াশে দই মেলা নিয়ে রয়েছে নানা গল্প-কাহিনী।
উল্লেখ্য: প্রায় তিনশ’ বছর আগে তাড়াশের তৎকালীন জমিদার পরম বৈঞ্চব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দই মেলার প্রচলন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে তৎকালীন পরম বৈঞ্চব জমিদার রাজা রায় বাহাদুর দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। এ ছাড়া জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করা হতো। আর সে থেকেই জমিদার বাড়ির সম্মুখে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী দই মেলা বসতো। প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে এই দই মেলা বসতো। কথিত আছে সবচেয়ে ভালো সুস্বাদু দই তৈরিকারক ঘোষকে জমিদারের পক্ষ থেকে উপঢৌকন প্রদান করার রেওয়াজ ছিল। তবে জমিদার আমল থেকে শুরু হওয়া দইয়ের মেলা এখনো মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে উৎসব আমেজে বসার বার্ষিক রেওয়াজ এখনো আছে। দই মেলা নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক তপন গোস্বামী বলেন, ‘খাঁটি দুধের সম্ভার খ্যাত সিরাজগঞ্জবাসী প্রাচীন আমল হতেই রসনা বিলাসী আর অতিথি পরায়ণ। দইয়ের মেলাটি জেলার আদি ঐতিহ্যের অংশ।’সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এ মেলার আয়োজন করা হলেও এখানে হিন্দু মুসলিম সব শ্রেনি পেশার মানুষ আসেন।