বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:২৬ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর:
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, রংপুর রংপুর জেলা জাতীয় মহিলা পার্টির সভানেত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও রংপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা শাহানারা বেগম আর নেই।
রোববার ভোরে রংপুর নগরীর গুড হেলথ হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত রোগাক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন তিনি।
রোববার বাদ আছর নগরীর কেরামতিয়া জামে মসজিদ সংলগ্ন প্রাঙ্গণে মরহুমার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে মুন্সিপাড়া করবস্থানে সমাহিত করা হয়।
শাহানারা বেগম শিক্ষকতা, সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে অতি পরিচিত এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তিনি ছিলেন রংপুরের প্রবীণ নারী গুণীজনদের মধ্যে অন্যতম। সবার কাছে তিনি ‘শাহানারা আপা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
জানাগেছে, ১৯৪০ সালের ২৯ মে রংপুরের হারাগাছ এলাকায় তার জন্ম। বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী । মা আমেনা খাতুন ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী। রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হলেও তিনি কিছুদিন পর রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ময়মনসিংহ থেকে বিএ, বিএড ডিগ্রি লাভ করেন।
যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার কর্মজীবনের শুরুটা। প্রথমে সাধারণ শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেও বিএড সম্পন্ন করার পর নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে এখানে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা এবং ১৯৮৮ সালে প্রধান শিক্ষিকা পদে দায়িত্ব পান। এরপর ১৯৯০ সালে পদোন্নতি লাভ করেন। পুরো কর্মজীবন এই রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার করে ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অবসর গ্রহণের পর তিনি নগরীর নিউ সেনপাড়ায় ড্রিমল্যান্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং হারাগাছ এশিয়ান ল্যাবরেটরি স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। শিক্ষকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৯৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। সেখানে দায়িত্ব পান রংপুর জেলা মহিলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়কের। পরবর্তীতে জেলা মহিলা জাতীয় পার্টির সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। স্কুল শিক্ষিকা থেকে রাজনীতির জটিল সমীকরণ ও নতুন পথচলায় তিনি ঠিকই মানিয়ে নেন নিজেকে। জাতীয় পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচি ও আন্দোলনে একজন সক্রিয় নেত্রী হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করেন।
২০১৪ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শাহানারা বেগম শিক্ষাঙ্গন কিংবা রাজনীতির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বিভিন্ন রকম সংগঠনে তার পদচারণা এবং আত্মিকতা তাকে পরিণত করেছে একজন হৃদয়বান সংগঠকে।
সাংগঠনিক জীবনে তার অন্যতম কর্ম ও অবদান গার্লস গাইডে। ছিলেন জেলা কমিশনার। একজন দক্ষ গার্লস গাইড সংগঠক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হওয়া ছিল তার কর্মের অন্যতম স্বীকৃতি। তিনি জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারি। একজন ক্রীড়া অনুরাগী এবং উৎসাহদানকারী অন্যতম ব্যক্তি তিনি। ছিলেন জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য। ছিলেন মহিলা সমিতি রংপুর শাখার সহ-সভাপতি। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমি, দুস্থ শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয় রংপুরের আজীবন সদস্য ও উপদেষ্টা, রংপুর কারাগারের পরিদর্শিকা, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি টান তার দীর্ঘদিনের। রংপুর সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি এবং রংপুর প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য, ছিলেন পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবের সদস্য। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের দিকনির্দেশনা প্রদানে তার আন্তরিকতার কথা মনে রাখার মতো। কবিতা লেখা, আবৃত্তি ও নাট্যাভিনয় ছিল তার অন্যতম শখ।
নারীদের কল্যাণে বিভিন্ন অবদানের জন্য ২০১২ সালে রোকেয়া দিবস উপলক্ষে রংপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বেগম রোকেয়া ফোরাম রংপুরের পক্ষ থেকে তাকে রোকেয়া সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। এছাড়া শ্রেষ্ঠ গাইডার হিসেবে জাতীয় পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে রংপুর বইমেলায় সম্মাননা, ২০০৭ সালে নাট্যশিল্পী হিসেবে সংবর্ধনা, ২০১১ সালে রংপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে সিনিয়র সিটিজেন এবং শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী হিসেবে সম্মাননা পদক, ২০১২ সালে রংপুর পৌরসভার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্মাননা লাভ, রংপুর গীতাঞ্জলির পক্ষ থেকে সাদা মনের মানুষ হিসেবে সম্মাননা তার উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি।
এদিকে তার মৃত্যুতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, রংপুর জেলা সভাপতি ও বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা, পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক, রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিটু শোক প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া রংপুর জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টি ও নগরীর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও শিক্ষকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। শোকবার্তায় এই গুণী সংগঠকের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।