রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২১ অপরাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
গা ঝাড়া দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুরু করেছেন কিছুটা হীনবল হওয়া দলকে চাঙা করার প্রক্রিয়া। বিশেষ নজর নড়বড়ে উত্তর প্রদেশে। নিশ্চিন্তে বসে থাকার মতো বিলাসিতার সময় যে নেই, বিলক্ষণ বুঝছেন। দিল্লি ডেকে পাঠিয়ে তাই কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে, ভোটের আগে ভোল বদলের মরিয়া তাগিদে।
ধাক্কাটা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। সত্যি বলতে কি, সাত বছরের শাসনকালে এত প্রবল ধাক্কা, আম্পান অথবা ইয়াসের চেয়েও যার অভিঘাত প্রবল, মোদিকে আগে সহ্য করতে হয়নি। আরও অসম্মান, সেই ধাক্কা মোদির ক্ষমতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে বলে। এ পর্যন্ত অর্জিত যাবতীয় অহংকার ও সব ধরনের ‘মিথ’-এর জলাঞ্জলি এভাবে হতে পারে, সেই কল্পনাও মোদি কখনো করেননি। পশ্চিমবঙ্গের লজ্জায় এক মাসের বেশি মৌনী হয়ে ছিলেন। অবশেষে গা ঝাড়া দিয়ে দলীয় নেতাদের বলেছেন, ‘জয় হবে। পরাজয়ও হবে। ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের ভোটের জন্য তৈরি হতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না।’ সতীর্থদের এ কথাও বলেছেন, ‘২০১৯ সালে অতগুলো আসন হারিয়েও তৃণমূল কংগ্রেস কী করে ঘুরে দাঁড়াল, সেই বিশ্লেষণে নিজেদের শিক্ষিত করতে হবে।’
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা ছাড়া মোদির উপায়ও নেই। এই মুহূর্তে ঘরে-বাইরে দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি। ‘বিশ্বগুরু’র মলিন ভাবমূর্তি ফের উজ্জ্বল করা বাইরের চ্যালেঞ্জ। ঘরের চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। কোভিড নিয়ন্ত্রণে কিল খেয়ে কিল হজমে বাধ্য হয়েছেন। টিকা নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রোষের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন তিনি সংবেদনশীল। দায় গ্রহণে প্রস্তুত। গণতন্ত্রী। পাশাপাশি নজর দিয়েছেন উত্তর প্রদেশে, যেখানে দলের মুঠো আলগা হয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীকে তাই তলব।
‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশের সমস্যা জটিল, বহুমুখী ও অভিনব। সর্বত্র ‘ঠাকুর’দের আধিপত্য দেওয়ার কারণে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের ওপর ক্ষিপ্ত দলের ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও দলিত-অনগ্রসর নেতারা। যে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ ২০১৭ সালে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিল, ৪০৩ আসনের মধ্যে একাই পেয়েছিল ৩১২, জোট মিলিয়ে ৩২৫, আদিত্যনাথের আমলে তা শিথিল হয়েছে। ড্যামেজ কন্ট্রোলের ভাবনায় মোদি-শাহ জুটি আপাতত আচ্ছন্ন।
লোকসভায় জেতা আদিত্যনাথ কিন্তু বিজেপির মূল স্রোতে কখনো গা ভাসাননি। তাঁর হিন্দুত্ববাদ আরও কট্টর, যার প্রসারে গড়ে তিনি তোলেন ‘হিন্দু যুব বাহিনী’। আজ রাজ্যজুড়ে ‘লাভ জিহাদ’-এর যে দাপাদাপি, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ না পালনের কড়াকড়ি, রোমিও পুলিশের হুড়োহুড়ি কিংবা গো-হত্যা বন্ধে বাড়াবাড়ি—মহল্লায় মহল্লায় এসবই নিশ্চিত করে হিন্দু যুব বাহিনী।
সন্ন্যাসী আদিত্যনাথের গৃহী নাম ছিল অজয় মোহন বিস্ত। জাতভিত্তিক উত্তর প্রদেশের সামাজিক বিন্যাস অনুযায়ী ‘ঠাকুর’ বংশীয়। ১৯৯০ সালে অযোধ্যা আন্দোলনের সময় গৃহ ত্যাগ করে তিনি গোরক্ষপুর ধামের সন্ন্যাসী মোহন্ত অবৈদ্যনাথের শরণাপন্ন হন। অবৈদ্যনাথ ছিলেন হিন্দু মহাসভার অনুগামী। গেরুয়া ধারণের পর অজয় মোহনের নাম হয় যোগী আদিত্যনাথ। অযোধ্যা আন্দোলনের সময় অবৈদ্যনাথ বিজেপিতে যোগ দেন। দেখাদেখি আদিত্যনাথও। ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ গোরক্ষপুর থেকে পাঁচবার লোকসভায় জেতা আদিত্যনাথ কিন্তু বিজেপির মূল স্রোতে কখনো গা ভাসাননি। তাঁর হিন্দুত্ববাদ আরও কট্টর, যার প্রসারে গড়ে তিনি তোলেন ‘হিন্দু যুব বাহিনী’। আজ রাজ্যজুড়ে ‘লাভ জিহাদ’-এর যে দাপাদাপি, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ না পালনের কড়াকড়ি, রোমিও পুলিশের হুড়োহুড়ি কিংবা গো-হত্যা বন্ধে বাড়াবাড়ি—মহল্লায় মহল্লায় এসবই নিশ্চিত করে হিন্দু যুব বাহিনী। হিন্দুত্ববাদী স্বকীয়তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে বাধ্য করেছিল আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী পদে মেনে নিতে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি-শাহর পছন্দের মানুষ ছিলেন না আদিত্যনাথ। তাঁরা চেয়েছিলেন বারানসির রাজনীতিক মনোজ সিনহাকে, এখন যিনি জম্মু-কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল।
আদিত্যনাথের হিন্দুত্ব, প্রশাসনিক স্টাইল, একগুঁয়েমি যে বিজেপির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে, সেই আন্দাজ সংঘ পরিবার সে সময় করতে পারেনি। সংঘ ভেবেছিল, হিন্দুত্ববাদী সমাজ গঠন, বিশেষ করে অযোধ্যায় মন্দির প্রতিষ্ঠা আদিত্যনাথের প্রশাসনিক দক্ষতায় সহজতর হবে। যোগীর ওপর অসন্তুষ্টদের অন্তহীন দরবারে প্রধানমন্ত্রী এখন বুঝেছেন, রাস টানতে না পারলে বিধানসভা ভোটে ভরাডুবি অনিবার্য। পঞ্চায়েত ভোটের ফল তারই ইঙ্গিতবাহী। মোদি তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ প্রশাসক অরবিন্দ শর্মাকে চাকরি ছাড়িয়ে রাজ্যের বিধান পরিষদের সদস্য করেন আদিত্যনাথকে বশে রাখতে। কিন্তু তিন মাস কেটে গেলেও প্রশাসনিক রদবদল করতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রীর চাপে। মোদি বুঝতে পারছেন, আদিত্যনাথ যেমন প্রধান সমস্যা, সমাধানও তেমন তিনিই। শ্যাম ও কুল—দুই ধরে রাখা এখন প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র লক্ষ্য।
কৃষকসমাজ বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি থেকে সরতে নারাজ, কেন্দ্রও আইন বাতিল না করার প্রশ্নে অনড়। এই অচলাবস্থায় দুপক্ষেরই নজর বিধানসভা ভোট।
সেই লক্ষ্যপূরণে গা ঝাড়া দিয়েছেন মোদি। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন। প্রথমটি কৃষক আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে গৃহীত। সাত মাস ধরে কৃষকেরা আন্দোলনে শামিল। রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে কৃষকনেতারা বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক সমর্থনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই সেদিন তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে জাট কৃষক সমর্থন বিজেপির প্রধান শক্তি। কৃষকদের সন্তুষ্ট করতে সম্প্রতি সরকার খরিফ মৌসুমের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য (এমএসপি) ধার্য করেছে। নতুন করে কৃষকদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজবে কি? বিষয়টা এখন জেদাজেদির পর্যায়ে। কৃষকসমাজ বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি থেকে সরতে নারাজ, কেন্দ্রও আইন বাতিল না করার প্রশ্নে অনড়। এই অচলাবস্থায় দুপক্ষেরই নজর বিধানসভা ভোট।
মোদির দ্বিতীয় কৌশল রাজ্যের ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণদের মনে প্রলেপ দেওয়া। সে জন্য কংগ্রেসের ব্রাহ্মণনেতা জিতিন প্রসাদকে দলে টেনেছেন। জিতিন প্রসাদ ব্রাহ্মণনেতা হলেও ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে হেরেছেন। তাঁকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রতীকী, ব্রাহ্মণসমাজের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া। বোঝানো যে বিজেপি তাদের বিরোধী নয়। পাশাপাশি আদিত্যনাথকেও এই বার্তা দেওয়া যে স্রেফ ‘ঠাকুরবাদ’ আর বরদাশত হবে না।
মোদির তৃতীয় সিদ্ধান্ত রাজ্যের সাবেক মুখ্য সচিব অনুপচন্দ্র পান্ডেকে নির্বাচন কমিশনের সদস্য নিযুক্ত করা। একদা আদিত্যনাথের অনুগত অনুপচন্দ্রের রাজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতাকে মোদি নির্বাচনী কাজে ব্যবহার করতে চান। জাতপাতভিত্তিক উত্তর প্রদেশে এই নিযুক্তিও বড় ইঙ্গিতবাহী। কেননা, অনুপচন্দ্র পান্ডেও ব্রাহ্মণ।
নরেন্দ্র মোদি সচেষ্ট। তবু শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। বিজেপির রাষ্ট্রীয় নীতি ও আদিত্যনাথের কাজের ধরন যে সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি করেছে, তাতে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে হলে ২০ শতাংশ মুসলমান ভোট হিসাবের বাইরে রাখতে হবে। ২০১৪ থেকে এই নীতি আঁকড়ে ৮০ শতাংশ হিন্দুকে বিজেপি এককাট্টা করতে পেরেছিল ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ ও মোদির ভাবমূর্তিতে ভর দিয়ে। মুজফফরনগরের দাঙ্গা সেই সমীকরণে সহায়ক হয়েছিল পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের জাটদের বদান্যতায়। কৃষক আন্দোলন জাট সমর্থনে থাবা বসিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটের ফল তার প্রমাণ। বিজেপি থেকে এখনো মুখ ফিরিয়ে ১২ শতাংশ ব্রাহ্মণ, ৪ শতাংশ কায়স্থ এবং অনগ্রসর ও দলিতদের একটা বড় অংশ, যারা গোরক্ষা আন্দোলনের বলি। ধর্ম ও জাতপাতের সমীকরণ মুছে জ্বলজ্বল করছে কোভিড নিয়ন্ত্রণে শাসকের পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতা। কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, জনসংখ্যার নিরিখে টিকাদানের ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে নিচে উত্তর প্রদেশ। এক ডোজের জাতীয় গড় যেখানে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, যোগী রাজ্যের গড় সেখানে ১২ দশমিক ১। দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন মাত্র আড়াই শতাংশ মানুষ, যেখানে জাতীয় গড় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
এত অব্যবস্থা, অসন্তোষ ও ফাঁকফোকর বুজিয়ে অসাধ্যসাধনে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দায় তাঁরই। কেননা, তিনি জানেন, উত্তর প্রদেশ যার পাশে থাকে না, বাকি ভারত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তা ছাড়া হাতে সময়ও মাত্র সাত-আট মাস।