রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা :
আসন্ন ৪র্থ ধাপের নির্বাচনে পাবনায় কয়েকটি সহিংসতা ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশের ভুমিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও আতংক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর ইউনিয়নে প্রতিপক্ষের হামলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক সেলিম নিহত হওয়ার পর নিহতের স্ত্রী খুশি খাতুন থানায় অভিযোগ দায়ের করার পরেও মামলা হিসেবে অর্ন্তভুক্ত না হওয়ায় পুলিশের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আটঘরিয়া পৌরসভার নির্বাচন ও ৫টি ইউনিয়নের সুষ্ঠ নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী, ভোটার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। সেই সাথে স্থাণীয়দের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। আটঘরিয়া পৌরসভার মেয়র প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম রতন ও তার পুত্র উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলামের নির্দেশে পুলিশ কাজ করছে বলে সরোজমিন ঘুরে ও একাধিক সুত্রের পাওয়া তথ্যে এমন আশংকা করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আটঘরিয়া পৌর মেয়র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম রতনের বিপক্ষে স্বতন্ত্র ২প্রার্থীর লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের শহিদুল ইসলাম রতনের বিপক্ষে নৌকা প্রতিকের মনোনয়ন পাওয়া ব্যাক্তি ও বিদ্রোহী প্রার্থীর উপর একের পর এক হামলা-মামলা ও গ্রেফতারে আতংকিত হয়ে পড়েছে স্থাণীয় জনগণ। অন্যদিকে বিদ্রোহী বা রতনের মতাদর্শের বাইরে নৌকা প্রতিকের প্রার্থীর সমর্থকদের উপর হামলার-মামলার আসামীদের গ্রেফতার না করে আইনের বৈষম্য সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। গত ৩ ডিসেম্বর চাঁদভা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী কামালের সমর্থক আব্দুল আল মতিনসহ ৪জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, জামায়াত চেয়ারম্যান প্রার্থী ওলিউল্লাহকে গালিগালাজ করার কারনে। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে জামায়াত প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে উপজেলার চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম। তানভীর গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকা প্রতিকের প্রার্থী মোবারক হোসেন পান্নুর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে জয়লাভ করেন। সে সময় উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম রতন তার পুত্র তানভীর ইসলামের পক্ষে প্রকাশ্যে জনসংযোগসহ নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তার পুত্রকে জয়লাভ করান।
এবারেও তার ছেলে তানভীর ইসলাম বাবাকে বিজয়ী করার জন্য প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি ও নেতাকর্মীদের তার বাপের পক্ষে কাজ করতে চাপ সৃষ্টি করছেন। আটঘরিয়া পৌর মেয়র প্রার্থী সাবেক ৭ বার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ইশারত আলী (জগ প্রতিক) অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ তাদের কর্মী-সমর্থকের নামে মিথ্যা ও হয়রানিমুলক মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করছে। এ ছাড়া কয়েকজনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে তিনি সেলিম হত্যাকান্ডের বিষয়ে বলেন, চঞ্চল পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম রতনের লোক হওয়ায় তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা গ্রহন করেনি পুলিশ। আরেক পৌর মেয়র প্রার্থী আশরাফুল ইসলাম জুয়েল (নারিকেল গাছ প্রতিক) একই অভিযোগ করে বলেন, তানভীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। তিনিও স্থাণীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা আইনের বৈষম্য সৃষ্টি করে রতন-তানভীরের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কাজ করে যাচ্ছে। সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি, পুলিশ মহা পরিদর্শকসহ নির্বাচন কমিশনারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এদিকে রতন-তানভীরের মতামতের বাইরে অবস্থান করায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিনা কারনে সাবেক ছাত্রলীগ ও বর্তমান যুবলীগ নেতা আল মামুনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠিয়েছে আটঘরিয়া থানা পুলিশ।
আাটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ মাকসুদা আক্তার মাসু বলেন, ঘটনার দিন ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে হামলার খবর পেয়ে আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রন করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। তবে সেলিম এর মৃত্যুর বিষয় নিয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এটা থানা পুলিশের বিষয়।
আটঘরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, যেহুতু সুরতহাল রিপোর্টে সেলিমের গায়ে কোন আঘাতের চিহৃ পাওয়া যায়নি, তাই তার স্ত্রীর দায়েরকৃত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করা হয়নি। নিহত সেলিমের ময়নাতদন্তের রির্পোট আসার পর হত্যা না স্বভাবিক মৃত্যু পরে দেখা যাবে। তবে ঘটনার দিন ওসি হাফিজুরের কাছে বিদ্রোহী প্রার্থীর উপর হামলা ও সেলিম হত্যার বিষয় মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি জানান, সেখানে কোন হামলার ঘটনা ঘটেনি এবং সেলিম হার্ডএ্যাটাকজনিত কারনে মারা গেছে। এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থী শাহিন হোসেন আমাদের এই প্রতিনিধিকে জানান, দেবোত্তর ইউনিয়নের নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাঈম্মীন হোসেন চঞ্চল এর ৪০/৫০ জনের একটি গ্রুপ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র্র নিয়ে তার এবং সমর্থকদের উপর হামলা করে। এ ঘটনায় বিদ্রোহী প্রার্থী শাহীন হোসেনের ৮/১০জন সমর্থক আহত হয়। এ সময় শাহিনও আহত হন। এরমধ্যে সেলিমকে পাবনা সদর হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু হয়। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করে। আহত অন্যরা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহন করে। ওই হামলায় বিবরণ দিতে গিয়ে ইউপি সদস্য প্রার্থী ও সাবেক আওয়াল মেম্বার বলেন, চঞ্চলের গুন্ডাবাহিনী আতর্কিত আমাদের উপর হামলা করে। এই সময় আমিসহ প্রায় ৮/১০জন আহত হয়। সেলিমসহ গুরত্বর আহত ৪/৫জনকে পাবনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। পরে মোবাইলে জানতে পারি সেলিম মারা গেছে। আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি মোবারক হোসেন পান্নু বলেন, বর্তমান ওসি হাফিজুর রহমান সাহেব বৈষম্যমুলক আচরন করছে। আমরা মামলা করলে আসামী গ্রেফতার হয় না। অথচ বাপ-বেটার সমর্থনকারীরা মামলা তো দুরের কথা মৌখিক অভিযোগ করলে আমাদের লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আরো জানান, একদন্ত ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম রতনের আস্থাভাজন সাবেক চেয়ারম্যান একদন্ত ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সরদারের ছেলে একদন্ত ইউনিয়নের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী লিয়াকত হোসেন আলালের সন্ত্রাসীবাহিনী গত ৮ ডিসেম্বর নৌকার প্রার্থী মোঃ মহসীন আলী মোল্লার সমর্থকদের উপর হামলা করে। এ ঘটনায় ৬/৭জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে নৌকা প্রার্থীর চাচাত ভাই সাবেক পুলিশের এএসআই রফিকুল ইসলাম ভাসানীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরন করেন। রফিকুলের অবস্থা আশংকাজনক। এ ঘটনায় আটঘরিয়া থানায় মামলা হলেও পুলিশ কোন আসামীকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া পুলিশের সার্কেল ফিরোজ কবির বলেন, নিহত সেলিমের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলে পরবর্তি ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তিনি এও বলেন নিহতের শরীরে কোন আঘাতের চিহৃ পাওয়া যায়নি।
তার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সুমাইয়া সিমু উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক দেবোত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নৌকা প্রতিকের প্রার্থী মোহাঈম্মীন হোসেন চঞ্চল এর বিরুদ্ধে তার বোনকে হত্যা ও তাকে ধর্ষনের অভিযোগ এনে পাবনা পুলিশ সুপার বরাবর যে অভিযোগটি দাখিল করেছিলেন, সেই অভিযোগের অগ্রগতি কতটুকু। পুলিশের সার্কেল ফিরোজ কবির বলেন, বিষয়টি তদন্তনাধীন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে মোহাঈম্মীন হোসেন চঞ্চল এর কাছ থেকে পুলিশ অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্যের কারনে গত ৬মাস পার হলেও সেই অভিযোগ আলোর মুখ দেখেনি।
সেলিম হত্যাকান্ডের বিষয়ে ময়নাতদন্তের রিপোট না আসা পর্যন্ত থানা হত্যা মামলা গ্রহন না করার আইনগত বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু বলেন, হত্যা মামলার অভিযোগ দায়ের করা হলে পুলিশ সেটা এজাহার হিসেবে গন্য করে তদন্ত করবে। এটাই নিয়ম। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এ যদি হত্যা প্রমানিত না হয়, তাহলে পুলিশ আসামীদের দায়মুক্তি দিয়ে এজাহারের ফাইনাল দিবে আদালতে। থানা পুলিশ মামলা গ্রহন না করা রহস্যজনক।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্থ সবাই মনে করেন, বর্তমান পাবনার পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান, ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া পুলিশ এর সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ কবির ও আটঘরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানকে নির্বাচনের আগে দ্রুত অপসারন করে সুষ্ঠও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনারসহ উচ্চ পর্যায়ের আইনশৃংখলাবহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে পাবনার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা ও আটঘরিয়া পৌর রিটানিং কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার কাছে এ ধরনের কোন অভিযোগ আসেনি।
মাঝপাড়া, দেবোত্তর ও একদন্ত ইউনিয়নের রিটানিং ও আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাচন কমকর্তা আব্দুস সামাদ বলেন, দেবোত্তর ইউনিয়নে গত ১৮ ডিসেম্বর শনিবার কোন হত্যাকান্ড বা সংঘর্ষ হয়নি। এটা বিদ্রোহী প্রার্থী নিজের ইমেজ সৃষ্টি করতে প্রচার করেছে। সেলিম হার্ড এ্যাটাকে মারা গেছে। তার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়, আহত যারা একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তারা কিভাবে আহত হয়েছিলেন। উত্তরে তিনি বলেন, সব অভিনয়।
এ বিষয়ে পাবনার পুলিশ সুপার মোঃ মহিবুল ইসলাম খান এর বক্তব্য জানতে তার মুঠো ফোনে, ফোন দিলে তিনি তা রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য পাবনা পৌর নির্বাচনে পুলিশ সুপার মোঃ মহিবুল ইসলাম খান এর ভুমিকায় তিনি ব্যাপক প্রসংসিত হয়েছিলেন। ৪র্থ ধাপের নির্বাচনে কয়েকটি হত্যাকান্ড, পরবর্তি পুলিশের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া আটঘরিয়া পৌরসভাসহ ৫ইউপি’র নির্বাচনে পুলিশের বৈষম্যমুলক আচরনে পুলিশ সুপারের ভুমিকাকে রহস্যজনক মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্থরা।