রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী, রাব্বানী:
সুদ কারবারি শহরবানুর কাছে থেকে চড়া সুদে ৫০ হাজার নিয়েছিলেন শামীমা (৫৫) নামের এক নারী। কিন্তু সুদ কারবারি শহরবানু রুপালী ব্যাংকের ফাঁকা চেকে সহি রাখে শামীমা বেগমের।
তিনি রাজশাহী মহানগরীর চন্দ্রিমা থানধিন -ছোট বনগ্রাম (পল্লবী) আবাসিক এলাকার মোঃ আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী। সেই ৫ বছর আগের কথা। টাকা নিয়ে বছর না যেতেই সুদের টাকার বিনিময়ে সুদ কারবারি শহরবানু তার লোকজন দিয়ে ভুক্তভোগী শামীমার বাড়ি সহ জমি দখল করে লিখে নেন। বলেন দেনা পাওনা পরিশোধ। তবে শামীমার দেয় রুপালী ব্যাংকের ফাঁকা চেকের পাতাটি ফেরত দেয়নি সুদ কারবার শহর বানু। এই ঘটনা ওই এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাসিন্দাদের জানা। বর্তমানে শহর বানু শামীমার সেই বাড়িতে তার ছোট স্বামীকে নিয়ে বসবাস করছেন। এরই মধ্যে গত (২৭ আগস্ট) মহানগরীর উপশহর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত রুপালী ব্যাংক থেকে শামীমা ডেকে পাঠান ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব। তিনি বলেন, শহর বানুর কাছে চেক রেখে ৮লাখ (আট লক্ষ) টাকা নিয়েছেন। তিনি চেক বাউন্স করতে এসেছিলেন। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আপনি আগামী ২দিনের মধ্যে তার টাকা ফেরত দিবেন। নইলে চেক বাউন্স করে দিবো। সে আপনার নামে আদালতে মামলা করবে। ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অসহায় নারী শামীমা। তিনি বলেন, সেই ৫ বছর আগে ৫০ হাজার টাকা সুদে নিয়ে ৮লাখ টাকা মূল্যের বাড়ি লিখে নিয়েছে শহরবানু। দেনা পাওনা পরিশোধ ঘোষনা করেছে। যাহা ওই এলাকার প্রতিটি পরিবারের লোকজন জানে। সেই থেকে আমি ভূমিহীন এবং এলাকা ছাড়া হয়ে গেছি। আবার সেই পুরানো চেক দিয়েই ৮ লাখ টাকার দাবি। আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ও প্রতিকার পাচ্ছি না। এখন আমার মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন উপাই নাই। এত টাকা দেবো কি ভাবে।
স্থানীয় আফরোজা বেগম জানান, এই শহর বানু এক হাজার টাকায় সপ্তাহে ২০০টাকা হারে সুদ নেয়। তার কাছে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ওই এলাকার অনেক নারী স্বামী হারিয়েছেন। আবার অনেকে ১০/২০ হাজার টাকা সুদে নিয়ে কয়েক ৫/১০ লক্ষ টাকা দিয়েও মুক্তি পাননি। সর্বস্ব হারিয়ে কাজের বুয়া হিসেবে পাড়ি জমিয়েছেন সৌদি আরব সহ কিছু মুসলিম দেশে। সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহর বানু কাইকে লক্ষ লক্ষ টাকা লোন দেন না। দেন ১০-২০-৩০ হাজার টাকা। যাদের টাকা দেন তাদের দিয়ে ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খোলান এবং জামানত হিসেবে ফাঁকা চেকের পাতায় সহি নেন। এরপর ১হাজার টাকায় প্রতি ৭দিনে সুদ ধরেন ২০০ টাকাঅ অর্থাৎ মাসে ১হাজার টাকায় নেন ৮০০টাকা সুদ। আর সেই সুদের টাকা দিতে কেউ দেরি করলে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে রিতি মতো লাঠি পেটা করে নির্যাতন করে শহরবানু ও তার মেয়ে। এই রকম নির্যাতনের একাধিক ঘটনা রয়েছে এই সুদ কারবারির। ২৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে সেলিনা নামের এক নারী ২০হাজার টাকা সুদ পরিশোধ করেছিলেন ১০ লাখ টাকা। এরপর তাকে মহর বানু তার নিজ বাড়িতে ডেকে আটকিয়ে নির্যাতন করে জোর করে ফাঁকা চেক আর স্ট্যাম্পে সহি নিয়ে ১২ লাখ টাকার দাবি করেন। তিনি দিকে অপারগতা জানালে শহরবানু, তার মেয়ে ও স্বামী সিরাজকে নিয়ে সেলিনার বাড়িতে ঢুকে বাড়ি লিখে নেওয়ার জন্য ব্যপক মারপিট করে সেলিনা ও বোন রোজিনাকে। ওই সময় স্থানীয়রা ৯৯৯-এ কল দিলে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের হাতেনাতে আটক করে। পরে তারা হাজত বাসের পর জামিনে মুক্তি পায়। ওই মামলা এখনো চলমান রয়েছে। ওই ঘটনার পর সুদ কারবারি শহরবানুর সার্বিক কর্মকান্ড নিয়ে একাধিক দৈনিক স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। দুদক সহ একাধিক প্রশাসনিক সংস্থা তদন্ত শুরু করে শহর বানুর বিষয়ে। কিন্তু শহর বানু জামিনে মুক্তি পেয়ে অল্প বয়সি এক যুবককে নিয়ে পালিয়ে বিওেয় করে আত্মগোপন করে। এরপর দীর্ঘদিন নিরব ছিলো শহরবানু। কিন্তু আবারও পূর্বের ন্যায় অন্যায় অত্যাচার শুরু করেছে সুদ কারবারি শহর বানু। স্থানীয়রা আরও বলেন, ৩০/৩৫ বছর আগে ফরিদপুর জেলা থেকে রাজশাহীতে শূন্য হাতে এসেছিলো শহরবানু। থাকতো সরকারী জমিতে। স্বামী কাজ করতো ট্রাকে। সুদের কারবার করে একাধিক বাড়ি ও কোটি কোটি মানিক বনে গেছে শহর বানু।
শহর বানুর অন্যায় রোধে প্রশাসনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী। সেই সাথে দুদকের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অন্যায় ভাবে উপার্জিত সম্পদ জব্দ করারও দাবি জানান তারা।
উল্লেখ্য, সুদ কারবারি ব্যক্তি এবং অনিবন্ধিত ও অনুমোদনবিহীন ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে (এমআরএ) ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দিয়েছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের লিখিত অনুলিপি (৬ অক্টোবর ২০২২) প্রকাশিত হয়েছে।
লিখিত আদেশের অনুলিপি প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ আদেশে হাইকোর্ট অনিবন্ধিত ও অনুমোদিত ক্ষদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে আদালত বলেছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে সুদ কারবারির কোনো সুযোগ নেই। কেউ এভাবে ব্যবসা করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আদেশে অনিবন্ধিত বা অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-ের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে কোনো অননুমোদিত বা অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সেগুলো বন্ধ করে আইনি ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। একইসঙ্গে চড়া সুদে ঋণদানকারী স্থানীয় মহাজন ও ঋণদানকারী স্থানীয় সুদকারবারিদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ক্ষুদ্র ঋণের নামে সারাদেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানি নিয়ে গত( ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১) বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক। একটি জাতীয় দৈনিকে ‘চড়া সুদে ঋণের জালে কৃষকেরা’ শিরোনামে গত (২৮ আগস্ট ২০২১) প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক ওই রিট দায়ের করেন। রিটে মহাজনদের উচ্চহারে অনানুষ্ঠানিক ঋণ প্রদান নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়। আবেদনে অর্থ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ১৩৬ ব্যক্তিকে বিবাদী করা হয়েছিল।