রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৫৯ অপরাহ্ন

News Headline :
ডিমের মূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে মধ্যস্বত্ব ভোগীরা বড় সমস্যা- মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ উপদেষ্টা কুষ্টিয়ায় বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ এর ১৩৪তম তিরোধান দিবস ২০২৪ উদযাপনের আজদ্বিতীয় দিন ইবিতে পরীক্ষা দিতে এসে তোপের মুখে ছাত্রলীগ নেতা কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে লালন মেলা হতে চুরি হওয়া ১৬টি মোবাইল ফোন উদ্ধার ন্যায় বিচার পেলে আওয়ামী লীগের জীবনের স্বাদ মিটে যাবে-নওগাঁ জামায়াত আমির রাবি’তে পরীক্ষা দিতে এসে ছাত্রলীগের ২ নেতা গ্রেফতার ফুলবাড়ীতে বিএনপি‘র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ২ পাবনার ঈশ্বরদীতে সন্ত্রাসীদের গুলি ল্যাংড়া বিপু গুলিবিদ্ধ পাবনায় স্বপনের অফিস ভাংচুর করলেন শিমুল সমর্থক হামলা-পাল্টা হামলা পাবনা র‌্যাবের অভিযানে পর্নগ্রাফি মামলার পলাতক আসামী গ্রেফতার

পঞ্চগড়ে তীর্থযাত্রার নৌকা ডুবে মৃত্যু বেড়ে ৫০ করতোয়া পাড়ে স্বজনদের আহাজারি বাড়ি বাড়ি শোকের মাতম

Reading Time: 6 minutes

হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর:

@ ৪০ কিলোমিটার দূরে আত্রাইয়ে মিলল ৭ লাশ
@ ‘ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার কারণে নৌকাডুবি’
@ স্বামীর প্রতীক্ষায় পানিতে চোখ ভাসাচ্ছেন নববধূ

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীর নদীর পাড়ে এখন নৌকা ডুবিতে নিহত স্বজনদের আহাজারি আর শোকের মাতম চলছে। তারা চান, যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়জনের লাশটি উদ্ধার করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক। নৌকা ডুবির ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর শুধু করতোয়া নয়; আশপাশের পুনর্ভবা, আত্রাই নদীর পাড় ধরেও স্বজনদের ছুটতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দলের নৌকার সঙ্গে তাল মিলিয়েও অনেকে চলছেন ভাটির দিকে।
সোমবার সকাল থেকে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে রোববার উদ্ধার করা হয় ২৫টি লাশ। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে নিখোঁজদের স্বজন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর রায় সোমবার বিকাল ৫টার দিকে মোট ৪৩ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর জানিয়েছিলেন।
এদিকে, নিখোঁজদের সন্ধানে গতকাল সোমবার সকাল থেকে আবারও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহীর ডুবুরি দল।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, স্রোতের টানে হয়তো লাশগুলো আশপাশের নদ-নদীতে চলে গেছে। করতোয়া নদী থেকে প্রচুর বালু ও পাথর উত্তোলন করে থাকে শ্রমিকরা। হতে পারে, লাশ সেই গর্তে পড়ে বালুতে ঢাকা পড়ে গেছে। এসব কারণে লাশ উদ্ধারে দেরি হচ্ছে বলে সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায়।
গত রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।
সকালেই মাড়েয়া ইউনিয়নের গেদিপাড়া গ্রামের কৃষ্ণ রায় (৫৫) এসেছেন দুই ছেলের লাশের খোঁজে। তিনি জানান, নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন ছেলে জগদীশ রায় (২৫) এবং অষ্ট রায় (২০)।
তিনি বলেন, “রোববার অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম। ছেলে দুটোরে পাইনি। আজও সকালে আবার এসেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবরই নাই। কী হবে, ভগবান কী রাগ করিছে?”
মা বিজু বালা (৫০), কাকীমা সুমি রাণীর (৪৫) খোঁজে করতোয়া পাড়ে এসেছেন মণিকা রাণী (৩০)। তিনি বলেন, “মা আর কাকীমা ছিল নিজের বোনের মতো। মা যেমন কোনো ভালো কিছু রান্না করলে আগে কাকীমাকে দিতেন, তেমনি ছিলেন কাকীমাও। তার বাসায় নতুন মেহমান আসলেও সেটা আগে মাকে জানাতেন।
সকালেই নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আরাজি শিকারপুর গ্রাম থেকে করতোয়া নদীর পাড়ে এসেছেন মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি জানান, তার পরিবারের এক সদস্য এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাশটি খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন।
একই গ্রামের আরেক তরুণ (২৪) বলেন, রাতেই অনেকেই টর্চলাইট নিয়ে নদীর পাড়ে খোঁজ করেছেন। যদি কারো লাশ ভেসে উঠে। ভোর হওয়ার আগেই অনেকে এসেছেন লাশের খোঁজে। কিন্তু লাশ উদ্ধারের ধীর গতিতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলি গ্রামের প্রভাত (৬৫) কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন, ছেলে কিশোর (৪৫), তার স্ত্রী কণিকা (৪০) ও ভাইয়ের মেয়ে পারুল ভগবানকে পূজা দিতে বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিল।
“কিন্তু নৌকায় লোক বেশি থাকায় আমি সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। ওরাও ভগবানের নাম জপে জপে যাচ্ছিল। তীরে যেতে যেতে ভগবান বুঝি ওদের ছেড়ে চলে যায়। ডুবে যায় নৌকা। একশর বেশি লোক সবাই নদীতে ভেসে যায়।”
করতোয়া পাড়ে আরেক বৃদ্ধ জানান, তার বোন ও বোনের শাশুড়ির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু বোনের মেয়ের লাশের জন্য তিনি নদীর পাড়ে এসেছেন।
এই বৃদ্ধ আরও জানান, আরাজি শিকারপুর গ্রামের একটি পরিবারের তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও দুজন নিখোঁজ রয়েছে। পরিবারটির মোট সাত সদস্য মন্দিরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিল। নৌকা ডুবির পর দুই বোন অর্পিতা ও আলোকে উদ্ধার করা হয়েছে। অর্পিতার দুই মেয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারটিতে এখন শোকের মাতম চলছে।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, বোদা উপজেলার ছত্রশিকারপুর গ্রামেরও একটি পরিবারের চারজন মারা গেছেন। এর মধ্যে দুজন নারী ও দুজন শিশু। তারা হলেন- গৃহবধূ তারা রায় (২২) ও লক্ষ্মী রানী রায় (২২), তারা রায়ের ছেলে দীপঙ্কর রায় (৫) এবং বিজন রায় (৭)।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এমনিতে খুব খরস্রোতা নয়; গভীরতাও খুব বেশি নয়। কিন্তু গত দুদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে অনেকটা।
নিহতদের মধ্যে উপজেলার রয়েছেন মাড়েয়া গ্রামের হেমন্তের মেয়ে পলি রানী (১৪), নির্মল চন্দ্রের স্ত্রী শোভা রানী, শালডাঙ্গা খালপাড়ের কার্তিকের স্ত্রী লজ্জা রানী (২৫), দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গা হাতিডোবা গ্রামের বাবুল চন্দ্র রায়ের ছেলে দিপংকর (৩), পশ্চিম শিকারপুর গ্রামের কালীকান্তর ছেলে অমল চন্দ্র (৩৫), বোদার মাড়েয়া বামনপাড়ার সজিবের আড়াই বছর বয়সী ছেলে পিয়ন্ত, মহানন্দর স্ত্রী খুকি রানী (৩৫), দেবীগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের চ-ী প্রসাদের স্ত্রী প্রমিলা রানী (৫৫), দেবীগঞ্জের হাতিডোবার শিকারপুর গ্রামের রবিনের স্ত্রী তারা রানী (২৪), পাঁচপীর বংশীধর পূজারী গ্রামের প্রয়াত ভুড়া মহনের স্ত্রী শোনেকা রানী (৬০), বোদার মাড়েয়া শিকারপুর প্রধান পাড়া গ্রামের শ্রী মণ্টুর স্ত্রী কাঞ্জুনি রানী (৫৫), পাঁচপীর জয়নন্দ্র বজয়া গ্রামের মহানন্দ মাস্টারের মা প্রমীলা (৭০), দেবীগঞ্জ তেলিপাড়া গ্রামের প্রয়াত কলিন্দ্রনাথের স্ত্রী ধনো বালা (৪৭), পাচঁপীর বংশীধর গ্রামের রথেশ চন্দ্রের স্ত্রী সুমিত্রা রানী (৫৭), ময়দানদিঘীর চকপাড়া গ্রামের বিলাস চন্দ্রের স্ত্রী সফলতা রানী (৪০), বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাসনহাট গ্রামের রমেশের স্ত্রী শিমলা রানী (৩৫), বোদা উপজেলার বড়শশী কুমারপাড়া গ্রামের হাচান আলী (৫২), একই উপজেলার আলোকপাড়া গ্রামের রমেশের শিশু কন্যা উশোশী, দেবীগঞ্জের হাতিডোবার নারায়নের শিশু কন্যা তনুশী, পাঁচপীর মদনহার গ্রামের রতন চন্দ্রের শিশু কন্যা শ্রেয়শী।

‘ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার কারণে নৌকাডুবি’
জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় বলেছেন, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার কারণে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল সোমবার সকালে বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে তদন্তকাজ পরিচালনা করতে এসে প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলা পরিষদের অধীন আউলিয়ার ঘাট খেয়াঘাটটির ইজারাদার আবদুল জব্বার। তিনি বোদা উপজেলার কুমারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এ ঘটনার বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
দীপঙ্কর রায় বলেন, রোববার আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার কারণে নৌকাটি ডুবে গেছে। অন্য কারণও থাকতে পারে। এখনো তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আজকের মধ্যেই তদন্ত শেষ করে আগামীকাল মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে।
পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক সৈয়দ মাহাবুবু আলম বলেন, পঞ্চগড় রংপুর কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে তিনটি ডুবুরি দল সকাল থেকে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে ভাটি অংশের ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিযান চালানো হবে।
৪০ কিলোমিটার দূরে আত্রাইয়ে মিলল ৭ লাশ
নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ সাত জনের মরদেহ দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলার আত্রাই নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে মরদেহগুলো ভেসে আসলে স্থানীয়রা পুলিশের খবর দেয়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস গিয়ে লাশগুলো উদ্ধার হয়।
পুলিশ বলছে, এর মধ্যে তিন শিশু, চারজন নারী রয়েছেন। নৌকা ডুবির স্থান থেকে আত্রাই নদীর এই স্থানের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। স্রোতের টানে এক রাতে লাশগুলো এতদূর ভেসে এসেছে।
একসঙ্গে ৪ জনকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন পরিবার
করতোয়ায় নৌকা ডুবিতে নিতদের ৪৭ জনের মধ্যে দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর এলাকার রবিনের পরিবারের রয়েছেন চারজন। একই পরিবারের চার জনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার পরিবারে। স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক রবিন। ছেলেকে হারিয়ে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন রবিনের ছোট ভাই বাবুল বর্মন।
নিহতরা হচ্ছেন- রবিনের স্ত্রী লিপি রানী, ৪ বছর বয়সী ছেলে বিষ্ণু বর্মন, কার্তিক বর্মনের স্ত্রী লক্ষী রানী (২৫) এবং রবিনের ভাতিজা তিন বছর বয়সী শিশু দীপঙ্কর বর্মন।
বাবুল বর্মন বলেন, ‘আমার তিনবছর বয়সী ছেলে দীপঙ্কর বৌদিদের সঙ্গে মন্দিরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো সে লাশ হয়ে ফিরবে।’
রবিন বর্মন বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তানকে পাঠিয়েছিলাম মহালয়া অনুষ্ঠানে। কিন্তু নৌকাডুবিতে আমার সব শেষ হয়ে গেলো। আমি এখন একা হয়ে গেলাম।
‘নাতির মরদেহ পেলে অন্তত সৎকারের কাজটা করতে পারতাম’
বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। তার রাত কেটেছে পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর তীরে। বসে আছেন নৌকাডুবিতে নিখোঁজ নাতির খোঁজে। এসেছেন উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে। তিনি বলেন, নাতির মরদেহটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম।
শুধু সুমল চন্দ্র নন, তার মতো আরও অনেকে অপেক্ষায় আছেন নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে। করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন অর্ধশতাধিক।
গতকাল সোমবার সকালে আউলিয়ার ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ফায়ার সার্ভিস এবং ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেখানে ভিড় করছেন নিখোঁজদের স্বজনেরা।
ষাটোর্ধ্ব কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ভাই এবং ভাইপোর খোঁজে এসেছেন আউলিয়া ঘাটে। তিনি জানান, নদীর ওপর পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে আয়োজিত ধর্ম সভায় যোগ দিতে তার ভাই নরেশ ও ভাইপো সিন্টু বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরেনি। নৌকাডুবির খবরে কাল থেকেই এখানে অপেক্ষা করছেন তিনি।
দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেন মা, মেয়ে নিখোঁজ
উঠার সময় দুলতে ছিল নৌকা। তবুও চাপাচাপি করে স্বামী, দুই সন্তান ও শাশুড়িসহ উঠেছিলাম নৌকাত। মাঝিরা কইছিল কিছুই হবে না। যাওয়া যাবে। কিন্তু দুলতে দুলতে মাঝখানে গিয়ে উল্টে গেল নৌকা। আমার বুকে বাচ্চাটা ছিল। বাম হাত দিয়ে বাচ্চাটা ধরে রাখছি আর ডান হাত দিয়ে নৌকা। পানির নিচে অনেকক্ষণ ডুবেছিলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারি না। পরে ঘাটে এসে জ্ঞান ফিরে। আমি আর বাচ্চাটা পড়ে আছি। কে ঘাটে নিয়ে আসছে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু আমার মেয়েটাকে এখনো খুঁজে পাইনি। আমার মেয়ের লাশটা হলেও উদ্ধার করে দিন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নৌকাডুবিতে বেঁচে যাওয়া বিপাশা চন্দ্র। বর্তমানে তার আট মাস বয়সী শিশুসন্তান সম্পদ রায় ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমার স্বামীসহ বাকি লোকগুলোর কথা আমি বলতে পারছি না। চারপাশে শুধু ডুবে যাওয়া দেখেছি। আমি আর কিছু বলতে পারছি না। মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন।
বেঁচে যাওয়া বিপাশার স্বামী বিলাশ চন্দ্র বলেন, নৌকা ডুবে যাওয়ার পর আমি নৌকার উল্টো পাশে উঠি। ওঠার পর শুধু সবার গলা আর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে পায়নি। মাকে দেখামাত্রই উদ্ধার করেছি। পরে ছেলে আর বউকে পেয়েছি। এখনো নিখোঁজ রয়েছে আমার মেয়ে। মেয়ের লাশটা হলেও উদ্ধার করে দিন।
স্বামীর প্রতীক্ষায় পানিতে চোখ ভাসাচ্ছেন নববধূ
দেড় মাস আগে হিমালয়ের বিয়ে হয় বন্যা রানীর সঙ্গে। মহালয়ায় পুণ্য অর্জনের জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বোদেশ্বরী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন নবদম্পতি হিমালয় ও বন্যা। মন্দিরে গিয়ে করতোয়ার পানিতেই পুণ্যস্নান করে পাপমুক্তির আশা ছিল তাদের। কিন্তু নৌকাডুবির ঘটনায় তাদের সে প্রত্যাশা নদীর পানিতে ভেসে গেছে। মাঝনদীতে নৌকা উল্টে অন্য অনেকের সঙ্গে পানিতে পড়ে যান এই নবদম্পতি। উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজের পরনের কাপড় ছুড়ে দিয়ে তীরে ওঠেন বন্যা। কিন্তু খোঁজ মেলেনি হিমালয়ের। বাকি জীবন একসঙ্গে চলার প্রতিজ্ঞাকে সংশয়ে ফেলে হিমালয় এখনো নিখোঁজ। স্বামীর প্রতীক্ষায় পানিতে চোখ ভাসাচ্ছেন বন্যা।
কথাগুলো বলছিলেন হিমালয়ের খোঁজে করতোয়ার তীরে অপেক্ষমাণ তার দুলাভাই গ্রি বাবু। শ্যালকের খোঁজে মধ্যরাত অবধি করতোয়ার তীরে অপেক্ষা করে গিয়ে ভোরে আবারো এসেছেন করতোয়া পাড়ে। কিন্তু হিমালয়ের খোঁজ মেলেনি।
হিমালয়ের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি খালপাড়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের বীরেন্দ্রনাথ-সারদা রানী দম্পতির ছেলে। দেড় মাস আগে হিমালয়ের বিয়ে হয় বন্যা রানীর সঙ্গে। মহালয়ার অনুষ্ঠানে পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে এক নৌকায় ছিলেন তারা। বন্যা সাঁতরে তীরে উঠলেও হিমালয় ও তার মামাতো বোন আঁখি এখনো নিখোঁজ।
গ্রি বাবু জানান, নৌকাডুবির ঘটনায় তার স্ত্রীর মামি ও খালা মারা গেছেন। রোববার তাদের মরদেহ পাওয়া গেছে। পরিবারের অপর দুই নিখোঁজ সদস্যের খোঁজে তারা নদীতীরে অপেক্ষা করছেন। বাড়িতে সবাই শোকে মাতম করছেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Design & Developed BY Hostitbd.Com