বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
আমাদের অনেক আশা, অনেক প্রত্যাশা। আমরা অনেক কিছু করতে চাই। অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলোর অন্ধকারের জীবন আলোকিত করতে চাই। কিন্তু এর জন্য চাই সচেতন একটি সমাজ, সরকারি প্রয়াস, গণমাধ্যম ও বিশ্ব নেতৃত্বের পূর্ণ সহযোগিতা।
বাংলাদেশের কন্যাশিশু
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” আমার প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ একটি সোনার দেশ আমি কি বিশ্বাস করি? সত্যিই কি দেশটিকে ভালবাসি? আমার মনে হয় আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করি না এবং দেশটিকে ভালবাসিনা। এমনটিও হতে পারে খাঁটি সোনাকে লুকিয়ে রেখে নকল সোনাকে প্রদর্শন করি এবং প্রকৃত ভালবাসাও আর নেই, আছে কৃত্রিমতা। আমার এই সোনার দেশে সোনার সন্তানেরা কৃত্রিম ভালবাসায় বড় হচ্ছে। বিশেষ করে কন্যা শিশুরা। স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের সমাজে প্রত্যেকেই প্রথমে পুত্র সন্তান আশা করে। তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আলট্রাসোনোগ্রামের মাধ্যমে গর্ভবতী মায়ের পুত্র সন্তান না কন্যা সন্তান ভুমিষ্ট হবে তা ভুমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই নির্ধারণ করা হচ্ছে। যদি কন্যাশিশু হয় তবে তাকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে দেয়া হচ্ছে না। নীরবে নিভৃতে চলছে হত্যাযজ্ঞ। তবে সরকারী-বেসরকারী এর কোন হিসাব নেই। উল্লেখ্য যে
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক কন্যাশিশু ভুমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই মাতৃগর্ভে হত্যা করা হচ্ছে। তাই বর্তমানে ভারতে ডাক্তারের বিশেষ নির্দেশ ব্যতিত মাতৃগর্ভের ভ্রæণ পরীক্ষা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের সমাজে কন্যাশিশুদের জন্য কতগুলো সামাজিক নিয়মকানুন চাপিয়ে দেয়া হয়। তাদের মতামতের প্রাধান্য দেয়া হয় না। তাদেরকে দুর্বল, অসহায়,কমবুদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা অবহেলা আর প্রতিকুল পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যা তাদের বিকাশের পথে অন্তরায়। কোন কাজ করতে গেলে শুধু বাঁধাগ্রস্ত
হয়। শুধু না, না, না শব্দটি বার বার শুনতে হয়। তাই তাদের মধ্যে সব সময় ভয় ও হতাশা কাজ করে। ফলে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠে না। অত্যন্ত আনন্দের সহিত বলতে হয় যে, বিগত দুই দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও সরকারী/ বেসরকারী উভয় পক্ষ থেকেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাস আসলে জিও, এনজিও কর্মী-সংগঠক, সকল পেশাজীবী কন্যাশিশুদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে। গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, কবিতা লেখা, স্মরণিকা প্রকাশ, র্যালী করা, আলোচনা অনুষ্ঠান করা, নাটক করা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা করা। আমি এগুলোর বিপক্ষে কিছু বলতে চাই না কারণ, এতে পরিবারে ও সমাজে সামান্যতম হলেও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন পরবর্তী সময়ে আমরা তা কতটুকু মনে রাখি? আজ আমি পল্লীগ্রামের অসহায় হতদরিদ্র পিতার দরিদ্রতম একটি কন্যাশিশুর কথা বলতে চাই। যে শিশুটি এক মুঠো ভাতের অভাবে মায়ের কোল ছেড়ে কাজের জন্য শহরে ছুটে আসে। তাদের রুগ্ন, অপুষ্টি চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় “সত্যি লক্ষী
মা ভাতের কাঙ্গাল!” তা না হলে কেন তাদের একমুঠো ভাতের অভাব হবে? বিধাতার নির্মম পরিহাস! অভাবের তাড়নায় কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে অবশেষে তারা বাধ্য হয় শহরের কোন এক প্রভাবশালী পরিবারের ক্রীতদাসত্ব বরণ করতে। জরিপে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই গৃহ পরিচারিকা হিসেবে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার। এদের শতকরা ৯০ জনের বয়স ৯-১৬ বছর। এদের মাসিক বেতন গড়ে ৫০০.০০ টাকার নীচ হতে শুরু করে ২,০০০.০০ টাকার উপরে নয়। শতকরা ৭১ ভাগের ক্ষেত্রে বেতনের টাকা পায় শিশু শ্রমিকের মা-বাবা। শ্রমিক হিসেবে কন্যাশিশুদের কদর অনেক বেশী। কেননা তারা সহজলভ্য ও অত্যন্ত অল্প মজুরীতে তাদের পাওয়া যায়। এছাড়াও তারা কাজের কোন কোন
ক্ষেত্রে বড়দের চেয়েও বেশী দায়িত্বশীল। শতকরা ৭১ ভাগ কন্যাশিশু মজুরীবিহীন শ্রমে নিয়োজিত। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই তাদের অবস্থান। শিশু শ্রমিক ছাড়া সংসার যেন এক মুহুর্তও চলতে চায় না। সংসার যদি হয় একটি জাহাজ ঐ শিশু শ্রমিকটি ঐ জাহাজের একজন নাবিক। এই নাবিকের উৎপত্তিস্থল অজপাড়াগায়ের খাঁটি সোনার পল্লী মায়ের কোল, যেখানে আদর, ¯েœহ, ভালবাসা সবই আছে নেই শুধু ভাত। ঢাকা শহরে যাদের ঘরে কন্যা শ্রমিক নেই, তাদের হাহাকারের অন্ত নেই। ঢাকার বাইরে যে সকল আত্মীয় স্বজন থাকেন তাদেরকে তাঁরা কন্যা বাহিনীর জন্য অতিষ্ট করে তোলেন। অনেক সময় একাধিক কন্যা শ্রমিক বাসায় রেখে তারা গর্ববোধ করেন। প্রতিবেশীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তারা উপরের স্তরে আছেন। তবে বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতি ও সার্বজনীন শিক্ষার জন্য কন্যাশিশু সরবরাহ বেশ কঠিন। কন্যা শ্রমিকদের নিয়োগের সময় বলা হয়, বাসায় তেমন কোন কাজ নেই, আমাদের কয়েকজনের ছোট সংসার মেয়েটিকে একটু রাখা, ছেলেটিকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া, ছুটি হলে আনতে যাওয়া, ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাসন-কোসন পরিষ্কার রাখা, কাপড় ধোয়া, মাঝে মধ্যে বাজারে যাওয়া, রান্না-বান্না করা, প্রয়োজন অনুসারে মসলা বাটা, যখন যা সামনে পড়ে তা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজ তেমন কঠিন কিছুই নয়। তবে সাবধান আমার সন্তানগণ যদি মানবাধিকারের নীতি ভুলে দানবাকারের প্রবক্তা হয়ে ওঠে তবু কিছুই বলা যাবে না। উল্লেখ্য যে ঐ সমস্ত সংসারের গৃহকত্রীরাই প্রধান ভূমিকায় থাকেন। তারা কন্যা শ্রমিকের সামান্যতম ক্রটি মেনে নিতে রাজি হননি। সবার ঘুম থেকে উঠার আগে তাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে নাস্তা তৈরী করার জন্য। আবার সবাই ঘুমুতে গেলে সবকিছু পরিষ্কার করে তাকে ঘুমুতে যেতে হবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যদি এর ব্যতিক্রম কিছু হয় তাহলে
নেমে আসবে দুর্বিসহ আঘাত। সকল কর্মচারির ছুটি থাকলেও তার ছয়টি ঋতুই একই রকম। আজকের কন্যা শিশু আগামী দিনের মা। যে মা সৃষ্টির ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে পৃথিবীকে জিইয়ে রেখেছে। সেই হবু মা অর্থাৎ কন্যা শিশুটির শিক্ষা,স্বাস্থ্য, অধিকার নিশ্চিতকরণ তথ্য সার্বিক অবস্থার সহায়ক পরিবেশ ব্যতিরেকে ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত স্বনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ সৃষ্টি কি সম্ভব? যদি উত্তর না হয় তবে কন্যা শিশুদের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। এমনকি জাতীয় পর্যায়েও কন্যাশিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো অন্যতম জাতীয় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অনেক আশা, অনেক প্রত্যাশা। আমরা অনেক কিছু করতে চাই। অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলোর অন্ধকারের জীবন আলোকিত করতে চাই। কিন্তু এর জন্য চাই সচেতন একটি সমাজ, সরকারি প্রয়াস, গণমাধ্যম ও বিশ্ব নেতৃত্বের পূর্ণ সহযোগিতা। এখন প্রয়োজন শুধু Human friendly শব্দটির পূর্ণ ব্যবহার। অর্থ্যাৎ Women friendly, Children friendly and life friendly হওয়ার। আমাদের কর্মে শিশু সাহসী হয়ে বেড়ে উঠুক। আমরা জানি চলার পথ খুব সহজ নয়। কিন্তু আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদেরকে যেতেই হবে, লক্ষ্যের অভিমুখে। তাই বাংলাদেশে ক্ষণজন্মা বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আসুন দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আমরাও বলি-“এ পৃথিবী শিশুর জন্য বাসযোগ্য করে যাবো, নব যাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
(৩০ সেপ্টেম্বর, জাতীয় কন্যা শিশু দিবস)
লেখক-
কামরুল হাসান
ময়মনসিংহ