শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৩ অপরাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
মাসুদ রানা রাব্বানী,রাজশাহী:
কৃষিপণ্যে উৎপাদন ও সরবরাহে সিংহভাগ শ্রম ও সময় দিলেও এসব পণ্যের লাভের ভাগ সবচেয়ে কম থাকে কৃষকেরই। প্রচলিত উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় লাভের সিংহভাগই পকেটস্থ হচ্ছে ফড়িয়া থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের। বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত নানা গবেষণায়ও উঠে এসেছে, ভোক্তাদের হাতে কৃষিপণ্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের (কৃষক থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা) মোট লাভের অংশ সবচেয়ে কম পান কৃষক। গত কয়েকদিন রাজশাহী জেলার মাঠ পর্যায়ের সবজি চাষি, ফাড়িয়া, সবজি বাজারের পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী এবং ভোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের মূল্য ও মুনাফার বণ্টনে জানা গেছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসব সবজির উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মোট লাভের সিংহ ভাগই ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগী ট্রেডার বা ফড়িয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত রোববার এক আটি লাল শাক কৃষক জমি থেকে ফাড়িয়ার নিকট বিক্রি করছে ৬টাকা, সেই লাল শাক ফাড়িয়ার পাইকারদেও নিকট বিক্রয় করছে ১০ থেকে ১২ টাকায় এবং খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫টাকায়। জেলার পবা উপজেলার নামোপাড়া এলাকার কৃষক প্রতি মন পটল ফারিয়ার নিকট বিক্রি করেছেন, ১৭শ’ টাকা, সেই পটল পাইকারী বাজার খড়খড়ি হাটে বিক্রি হচ্ছে ২২শ’ টাকা এবং নগরীর সাহেব বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০টাকা (প্রতি মণ ২৮শ’ টাকা) দরে। এতে করে কৃষকদের নিকট থেকে বিভিন্ন হাত ঘুড়ে ভোক্তাকে ক্রয় করতে হচ্ছে ২৭টাকা বেশি দরে।প্রতি মণ করলা কৃষকের জমি থেকে বিক্রি হয়েছে ২২শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা এবং পাইকারী বাজারে বিক্রি হয়েছে তিন হাজার থেকে তিন হাজার দুইশ টাকা মণ দরে। সেই হিসেবে কৃষক পাচ্ছে প্রতি কেজি ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা, পাইকাররা পাচ্ছে প্রতি কেজি করলার দাম পড়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা করে। কিন্তু সেটিই রাজশাহী শহরে বিক্রি হয়ে ৯০-১০০ টাকা কেজিতে। আবার বরবটি কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ১৩শ’ থেকে ১৬ টাকা, পাইকাররা বিক্রি করছে প্রতি মণ ১৮শ থেকে ২৫শ টাকা দরে। সেই হিসেবে প্রতিকেজি বরবটি কৃষক দাম পেয়েছেন ৩৭ থেকে ৪০টাকা। কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে রাজশাহী শহরে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে।অন্যদিকে, জেলার সিংহভাগ মাঠ পর্যায়ের কৃষক সরাসরি পাইকারী বাজারে তাদের সবজি বিক্রি করতে আসলেও ফাড়িয়া ও পাইকারদের সিন্ডিকেটে তারা জিম্মি হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক আজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা খ্যাতে ফসল ফলাই (উৎপদান করি)। দাম পাই আর না পাই হাটে অ্যাসি বিক্রি করতেই হবি। এখুন একটু দাম প্যাচ্চি। তাই পটল বিক্রি করি কিছুটা লাভ হচ্ছে। তার পরে সার বিষের যে দাম সবজি চাষ করে এখুন লাভ বার করা খুব কঠিন। যখন দাম পাবো না, তখুন ক্ষতি হবি। তাও ফসল তো আমাদের করতেই হবি। আমাদের লাভ হইলো না ক্ষতি হইলো, সেডা দেখার তো কেউ নাই। যারা আমারে কাছ থেকে জিনিস কিনি নিয়ে য্যায়ে অন্য যাগাত বিক্রি করতিছে, তাদের লাভ কিন্তু ঠিকিই হচ্চে।’ তিনি বলেন, “যেই হাটেই যাই না কেন, ফাড়িয়া এবং পাইকারদের নিকট আমরা জিম্মি, তারা যেই দও বলবে সেই দরেই বিক্রি করতে হবে”।আরেক কৃষক মুকবুল হোসেন বলেন, ‘ গত কয়েকদিন আগের ভারি বৃষ্টির কারণে অনেক সবজি ডুবে গেছে। এ কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যার কারণে সবজি এবার শীতে অনেক কম হচ্ছে। ফলে দাম বেশি পেলেও কৃষকরা খুব একটা লাভবান হচ্ছে না। তার পরেও আমরা যাদের নিকট বিক্রি করছি তারা কিন্তু শহরে কেজিতে কমপক্ষে ৩০ টাকা লাভ করে বিক্রি হয়।’বিপণন ও সরবরাহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদিত এসব কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন। তবে এসব ব্যবসায়ী কী মাত্রায় মুনাফা করবেন, সে বিষয়ে কোনো তদারকি বা নিয়ম-নীতি নেই। যে কারণে কৃষক থেকে ভোক্তা এর মধ্যে চার শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের মধ্যেই অনৈতিক মুনাফাপ্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি এবং সময়ে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে উৎপাদক যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ঠকছেন দেশের ভোক্তারা। বর্তমান সময়ে সেই প্রবণতা আরো বেড়েছে। তাই সঠিক ও কার্যকর নীতিমালার মাধ্যমে এ দূরত্ব কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।তারা বলছেন, কৃষকের মুনাফা বাড়াতে বিভিন্ন সময়ে অর্থসহায়তাসহ নানা পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়। তবে সার্বিকভাবে এসব পদক্ষেপের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গিয়েছে। পদক্ষেপগুলোর সুবিধাভোগী নির্বাচন ও সুবিধা বিতরণের প্রক্রিয়াগুলো বারবার অকার্যকর প্রমাণ হলেও তাতে পরিবর্তন আসেনি। ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।