বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ অপরাহ্ন

News Headline :
কুষ্টিয়ার নিখোজ ২ এএসআই এর লাশ পদ্মা নদী থেকে উদ্ধার এবার প্রকাশ্যে এলেন ইবি শিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারি গোদাগাড়ীতে বিপুল পরিমান গাঁজা-সহ গ্রেফতার মাদক কারবারী ডালিম আমরণ অনশনে রাবি আইন অনুষদের শিক্ষার্থীরা পুলিশ কর্মকর্তা বিজয়-উৎপলকে ধরলেই মিলবে কাজেম হত্যার উত্তর: দাবি চিকিৎসকদের সিরাজগঞ্জে ব্যবসায়ী হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে  বিক্ষোভ ও মানববন্ধন  দেশদ্রোহী খুনি হাসিনাকে দেশে এনে বিচার করতে হবে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে–আহসান হাবিব লিংকন রংপুরে জমি লিখে না দেয়া মাকে বেধড়ক পেঠালো ছেলে ও ছেলের বউরা শ্রীবরদীতে যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এতিম ও অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ মান্দায় মসজিদ উন্নয়ন প্রকল্পের সাড়ে ৩শো গাছ উপড়ে ও ভেঙ্গে ফেলার অভিযোগ

ধান পাওয়া যাচ্ছে না, গেল কই

Reading Time: 5 minutes

নিজস্ব প্রতিবেদক:

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ইরাদা ছিল, এবার বোরো মৌসুমে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ১২ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হবে। প্রতি কেজি ২৭ টাকা দরে ধান কেনা হবে কৃষকের কাছ থেকে। আর সেদ্ধ চালের দাম কেজি ৪০ টাকা ও আতপ চাল ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা কেনা হবে চালকলমালিকদের কাছ থেকে। কিন্তু ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ধানের নিখোঁজ সংবাদে বড়ই বেচাইন; তাঁর ঘুম মাটি। ১৬ জুন ‘অভ্যন্তরীণ বোরো সংগ্রহ ২০২১’ কার্যক্রমের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় তিনি জানতে চান, দেশে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে কেন খাদ্য অধিদপ্তর ধান কিনতে পারছে না?

সেদিন সচিবালয়ের নির্ধারিত সভায় মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না। তবে প্রধান অতিথি হিসেবে যন্ত্রযুক্ত ছিলেন। আগের সভাগুলোর মতো এই সভায়ও মন্ত্রী ধান চাই, ধান চাই; যে করেই হোক, ধান চাই বলে তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন। গত এপ্রিল মাসের শেষে বোরো ধান ওঠার সময় থেকে মন্ত্রী সশরীর বা যন্ত্রযুক্ত হয়ে যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই ধান সংগ্রহের তাগিদ দিয়েছেন। তাঁর ‘চাষি বন্ধু’ বক্তব্যে সবাই মুগ্ধ হয়েছেন।

মৌসুমের শুরুতে নিজের নির্বাচনী জেলা নওগাঁর বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করতে গিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, চলতি বোরো মৌসুমে যেকোনো মূল্যে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রধান দপ্তর থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সতর্কতার সঙ্গে সচেষ্ট থাকতে হবে। খাদ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে খাদ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি খাদ্যগুদামে কর্তব্যরত শ্রমিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ ক্ষেত্রে কৃষকেরা যাতে কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয়। কৃষকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে এবং সরাসরি কৃষকদের কাছে থেকেই ধান সংগ্রহ করতে হবে।

মন্ত্রী অভিজ্ঞ মানুষ। ধান-চালের ব্যবসার শিকড় তাঁর জানা। সরকারি কেনাবেচায় ‘সিন্ডিকেটের’ কারিশমা তাঁর ‘নলেজের’ বাইরে নয়। তাই বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি আপাত অদৃশ্য সিন্ডিকেটের প্রতি একটু কঠোর ভাষা ব্যবহার করতেও ভোলেননি। তবে সে ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের অশেষ শক্তির কথা ভেবে তিনি তাঁদের সাবধান করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। এ ক্ষেত্রে কোনো সিন্ডিকেট সহ্য করা হবে না।

মিলমালিকদের খাসলতও মন্ত্রীর জানা। তাই তাঁদের উদ্দেশে সেই সভায় তিনি বলেছিলেন, মিলমালিকেরা সময়মতো চুক্তি সম্পাদন করবেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের দেওয়া চাহিদাপত্র অনুযায়ী চাল গুদামে সরবরাহ করতে হবে।

কিন্তু সরবরাহ না করলে কী করা হবে সেটা মন্ত্রী বলেননি। তিনি এটাও বলেননি যে আগে যাঁরা চুক্তি করে মানেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ তালিকায় নাম ওঠার পর যেসব কৌশলে আবার তাঁরা নামে-বেনামে তালিকায় শামিল হয়ে যান, তাঁদের কী হবে। মন্ত্রী অবশ্য আরেকটা নষ্ট হাতের কথা জানেন। সে কথার ভেদ ভেঙেছিলেন ময়মনসিংহে। সেখানকার খাদ্যগুদামের নবনির্মিত অফিস ভবনের উদ্বোধন করতে গিয়ে ৪ জুন তিনি পরিষ্কার করেই বলেন, বিনা লাইসেন্সে খাদ্য মজুত করে কেউ সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করবেন না। তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে সব বক্তব্যের শেষে মন্ত্রী একটা কথা বলতে মোটেও ভুল করেননি। বেশ পরিষ্কার গলায় তিনি জানিয়েছেন, সংগৃহীত ধানের গুণগত মান শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। ধানের গুণগত মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না।

ক্রয়কেন্দ্রে কর্মকর্তার মনের মতো খটখটে শুকনা ধান কৃষক সব সময় আনতে পারেন না। ধান নিয়ে এসে ক্রয়কেন্দ্রের সাহেবদের কাছে পাস করাতে না পারলে ফেরত নিয়ে যাওয়া মহাঝক্কির ব্যাপার। তাই কৃষক একটু ভালো দাম পেলে হাটই তাঁর পছন্দ, সরকারি ক্রয়কেন্দ্র নয়।

হাটের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, বিক্রি না হলে কাছের চাতালে-গুদামে রেখে যাওয়া যায়, বিক্রি হলে একটা রাখা খরচ ধরে দিলেই হয়। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে সে সুবিধা নেই। হাটে আবার নগদ টাকায় কেনাবেচা হয়। প্রান্তিক কৃষকেরা দেনা শোধের তাগিদে নগদে কেনাবেচার বাইরে যেতে পারেন না।

সরকার গত বছর বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনে। তবে বাজারে চালের দাম বেশি ছিল। ফলে গত বছর বোরো ও আমনে লক্ষ্য অনুযায়ী ধান-চাল কিনতে পারেনি খাদ্য অধিদপ্তর।

এবার গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান ও ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। দাম ঠিক করার সভাগুলোতে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সব সময় এ কথাই বলেছিল যে ধান ও চালের এমন একটি সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, যেটা বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা না হলে মূল্য নির্ধারণ করে কোনো লাভ হবে না। সরকার আগের মতো ধান-চাল কিনতে পারবে না। তাদের নির্ধারিত দাম যে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি, তা এখন সবাই বুঝতে পারছে।

যশোরে গত ১২ জুন পর্যন্ত সরকারি খাদ্যগুদামে জমা পড়েছে সাকল্যে ৪ হাজার ৪৮৭ টন ধান। সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৮৭৯ টন। সেখানে খোলাবাজারে ধানের দর সরকার ঘোষিত দামের চেয়ে মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেশি। ফলে কৃষকদের মধ্যে সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রিতে অনীহা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধান সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন।

আমন সংগ্রহ অভিযানে ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর চলতি বোরো মৌসুমে রংপুরে আবারও ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে। আমন মৌসুমে রংপুর জেলায় সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৩৮২ টন। এর মধ্যে শুধু পীরগঞ্জ উপজেলায় সংগ্রহ হয়েছে দুই টন। বাকি সাত উপজেলা থেকে ধান সংগ্রহ করা যায়নি।

প্রথম আলোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, রংপুর অঞ্চলের বড় মোকাম বদরগঞ্জে ফড়িয়ারা ধান কিনছেন অটো রাইস মিলের জন্য। বদরগঞ্জ খাদ্যগুদামে ২ হাজার ৪০০ টন ধান কেনার লক্ষ্যের বিপরীতে গত এক মাসে কেনা হয়েছে ৪২০ টন এবং ২ হাজার ১৩ টন চালের বিপরীতে ১ মাস ১০ দিনে কেনা হয়েছে মাত্র ৫১০ টন। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা আছে ৩০ জুনের মধ্যে বরাদ্দের বিপরীতে খাদ্যগুদামগুলোতে ৭৫ ভাগ ধান-চাল ক্রয় নিশ্চিত করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে বোরো মৌসুমে সংগ্রহ-দশা আমনের চেয়ে ভালো হবে না।

বাম্পার বাম্পার বলা হচ্ছে, আসলে কি উৎপাদন কম হয়েছে? এটা ঠিক যে আমাদের হিসাব এখন অনেকটা আন্দাজনির্ভর। পরিসংখ্যান বিভাগের
সঙ্গে কৃষি দপ্তরের হিসাব মেলা না-মেলার গল্প অনেক দিনের পুরোনো। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (সংক্ষেপে স্পারসো) স্যাটেলাইট ইমেজের সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি বিভাগ মিলে একটা গ্রহণযোগ্য
হিসাব বের করার চেষ্টার কথা শোনা যায়। আশা করা যায়, একদিন আমরা এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারব। কেতাবের গরুর সঙ্গে গোয়ালের হিসাব মিলবে।

অবশ্য এবার যে ফসল আগের বছরের চেয়ে ভালো হয়েছে, তাতে কোনো ভুল নেই। শুধু বোরো নয়, কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে আউশের আবাদও বেড়েছে। বোরো মৌসুমে হিটশকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কোথাও কোথাও বোরো ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে হাওরে আগাম পানি এসে ক্ষতি না হওয়ায় মুরিধান বা ডেমি ধানের ফলন হয়েছে অত্যন্ত ভালো। মূল ফলনের ২০ থেকে ৩০ ভাগ আসে মুরিধান থেকে। এত সবের পরও বোরোর একবারের বাম্পার ফলন দিয়ে কি দুটো মৌসুমের ঘাটতি মেটানো সম্ভব? চলতি অর্থবছরে আমনের উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বন্যায় আমনের ক্ষতি হয়। করোনার প্রভাবও পরোক্ষভাবে কিছুটা পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) হিসাবে চলতি অর্থবছরে আমন চালের উৎপাদন গত অর্থবছরের তুলনায় ৭ লাখ টন কমে ১ কোটি ৩৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। তার আগের বোরোতেও ভালো হয়নি, পূরণ হয়নি ২ কোটি ৪ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদনের লক্ষ্য। আগের দুই বছরে বোরো চাষিরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কিছুটা কম পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ হয়। তা ছাড়া করোনার কারণে কৃষকেরা সময়মতো সার কিনতে পারেননি। আম্পানেও উপকূলীয় নয় এমন অনেকগুলো জেলায় বোরো ফসলের ক্ষতি হয়। এত সব ঘাটতি এবারের এক বোরোর ভালো ফলন দিয়ে কি মেটানো সম্ভব?

সুতাটা ছিঁড়ে দিন
এই তথ্য সবাই জানে যে সরকারি গুদামে চালের মজুত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছিল। গত আমন মৌসুমে সাড়ে ৮ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে চালের আকারে মাত্র ৮৩ হাজার টন। সরকার জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করার পরেও দেশের বাইরে থেকে সময়মতো ‘প্রয়োজনীয় চাল’ আমদানির প্রচেষ্টা সফল হয়নি। দেশের বাইরে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক অনেক কমিয়ে দিয়েও বেসরকারি খাতকে চাল আমদানিতে মাতানো যায়নি।

খোলা বাজারে এখন মোটা চালের খুচরা মূল্য ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। এই অঙ্ক মন্ত্রীর চিহ্নিত ‘সিন্ডিকেট’, মিলমালিক আর লাইসেন্স ছাড়া মজুতদার সবাই বোঝেন। তাই ফড়িয়ারা ধান কিনছে মিলমালিকদের জন্য। মিলমালিকেরা সেই ধান থেকে চাল করে কেন সরকারকে প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে দেবেন, যখন বাজারে দাম অনেক বেশি।

মজার ব্যাপার, মিলমালিকদের এই লাগাম ছাড়া আচরণের পেছনে অর্থের জোগান দেয় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক। তাদের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। হুমকি-ধমকি নয়, ব্যাংকঋণের সুতাটা ছিঁড়ে দিলেই মিলমালিকদের মাছের তেলে মাছ ভাজার শখ মিটে যাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Design & Developed BY Hostitbd.Com