শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
নিজস্ব সংবাদদাতা:
দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায় তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের উপলব্ধি, ‘‘তিনি থাকায় লাভ তো বিশেষ কিছু হয়নি। ক্ষতি আর কী হবে?’’
অথচ এই মুকুলকে নিয়েই বিজেপির একাংশের গর্বের সীমা ছিল না। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর দিল্লিতে দলের কেন্দ্রীয় দফতরে নিয়ে গিয়ে মুকুলকে যোগদান করান বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। তৃণমূলকে ধাক্কা দিতে এটা একটা বিরাট পদক্ষেপ বলেও প্রচার করেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়—সকলেই নানা সময়ে নানা সভায় মুকুলের প্রশংসা করেছেন। এমনকি, শুক্রবার মুকুল তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেও জনান্তিকে রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতার স্বীকারোক্তি, ‘‘পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটে মুকুলদা’র অবদান অস্বীকার করা যাবে না। এখন মুকুলদা তৃণমূলে চলে যাওয়ায় বিজেপির কাছে উনি হয়েছেন আঙুরফল টক!’’
বস্তুত, মুকুল বিজেপি ছাড়ার পরে গেরুয়া শিবির কার্যত দিশেহারা। তিনি যে এ দিনই তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন, তার ইঙ্গিতটুকুও বিজেপির কাছে আগাম ছিল না। বিজেপিতে মুকুল যে সর্বভারতীয় নেতার সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেই কৈলাস-সহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ দিন কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। তবে সূত্রের খবর, মুকুল এ দিন বাড়ি থেকে তৃণমূল ভবন যাওয়ার সময় তাঁর কাছে দিল্লি থেকে অনেক ফোন আসে। কিন্তু তিনি কোনও ফোন ধরেননি।
পরে রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার সাংবাদিক সম্মেলন করে মুকুলের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের প্রতিক্রিয়া জানান। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনটা তিনি শুরুই করেন এমন ভাবে, যেন এ দিন এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। পরে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘পুরনো দলে নতুন ইনিংসের শুরুতে আমরা মুকুলবাবুকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। রাজনৈতিক পটভূমিকায় তাঁর এই পদক্ষেপের বিচার ভবিষ্যতে হবে। তবে তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি এবং বিধায়ক পদ ছেড়েছেন বা ছেড়ে দেবেন বলে আমাদের আশা।’’
মুকুল-কাণ্ডে বিজেপির অন্তর্কলহও এ দিন ফের পাকিয়ে উঠেছে। দলীয় সূত্রের খবর, দিলীপ-গোষ্ঠীর নেতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুকুলকে দলে নিয়েছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মুকুল-কাণ্ডের পরে এ দিন রাজ্য বিজেপির ওই নেতারা দায় চাপাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপরেই। রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘আমাদের কথা না শুনে কেন্দ্রীয় নেতারা যা যা করেছেন, সবেতেই যে হাত পুড়েছে, তা প্রমাণিত হচ্ছে।’’
বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা টুইট করেছেন, ‘‘নির্বাচন চলাকালীন দু’-এক জন নেতাকে নিয়ে অতি মাতামাতি এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লবিবাজি করে বাকিদের বসিয়ে রেখে অবজ্ঞা বা অপমান করার করুণ পরিণতি!’’
মুকুলের তৃণমূলে ফিরে যাওয়া দলের ভাঙনে আরও ইন্ধন জোগাবে বলে আশঙ্কা করছে বিজেপির একাংশ। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘মুকুল রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভাকে হাতের তালুর মতো চিনতেন। বিধানসভা নির্বাচনে মুকুলকে স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসাবে ব্যবহার করা যেত। দল তা করেনি।’’
দলের অন্য অংশের অবশ্য মত, মুকুলবাবু কখনওই বিজেপিতে একাত্ম হতে পারেননি। দলের কোন কোন সাংসদ এবং বিধায়ক এর পরে তৃণমূলে যেতে পারেন, তা-ও এ দিন থেকে মরিয়া হয়ে খুঁজতে শুরু করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন অন্তত ৭ জন। যদিও তাঁদের চার জন নানা ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া নিয়মিত দিয়ে চলেছেন। তবে তা ‘নাটক’ কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াচ্ছেন বিজেপি নেতারা।
মুকুলের বিজেপি-ত্যাগ জাতীয় স্তরেও দলকে বিপাকে ফেলতে পারে বলে অনেকের মত। বিজেপির ওই নেতাদের ব্যাখ্যা, উত্তরপ্রদেশে আগামী বছর আসন্ন বিধানসভা ভোটে মোদী-যোগী দ্বন্দ্ব প্রভাব ফেলতে পারে। কর্নাটক, রাজস্থান, গুজরাত এবং মধ্যপ্রদেশেও দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব রয়েছে। তার উপর পশ্চিমবঙ্গে মুকুলকে দিয়ে এ দিন বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার যে ধারা শুরু হল, তা অব্যাহত থাকলে উত্তরপ্রদেশের ভোট বিজেপির পক্ষে মসৃণ হবে না।
মুকুলের হাত ধরে যাঁরা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও অনেকে এ দিন তাঁকে নিশানা করেছেন। যেমন, সাংসদ অর্জুন সিংহ বলেন, ‘‘আমরা কৈলাসজি’কে বার বার বলেছিলাম, ওঁকে বিশ্বাস করবেন না, উনি খবর পাচার করেন। কিন্তু উনি ওঁকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।’’ বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ কৈলাসের নাম না করে বলেন, ‘‘আমাদের দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক প্রশ্রয় দিয়ে মুকুলদাকে মাথায় তুলেছিলেন।’’
বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা তথা ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘মল-মূত্র ত্যাগ করলে মানুষ দুর্বল হয় না, সবলই হয়।’’ টুইটে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের কটাক্ষ, ‘‘মুকুলদা যে ধরনের ঘোলাজলে সাঁতার কাটতে ভালবাসেন আর ‘গভীর জলের মাছ’ ধরেন, সেখানেই খুশি মনে ফিরে গেছেন, এটা বেশ ভালই হয়েছে!’’