বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৪ অপরাহ্ন

News Headline :
রংপুরে জমি লিখে না দেয়া মাকে বেধড়ক পেঠালো ছেলে ও ছেলের বউরা শ্রীবরদীতে যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এতিম ও অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ মান্দায় মসজিদ উন্নয়ন প্রকল্পের সাড়ে ৩শো গাছ উপড়ে ও ভেঙ্গে ফেলার অভিযোগ ১৫ মাস গণরুমে থেকেও বরাদ্দ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা; সমালোচনা ঝড় রাজশাহীতে অর্ধকোটি টাকার হেরোইনসহ মাদক কারবারী গ্রেফতার স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের বিচার দাবিতে ইবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ রংপুরে কাওছার জামান বাবলার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বসতভিটা দখল চেষ্টার অভিযোগ মহানগরীর ভদ্রায় বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে এক শিশুর মৃত্যু পাবনা জেলা কৃষকদলের কমিটি ঘোষনা সভাপতি হাশেম সাম্পাদক আসিপ আনন্দ র‌্যালী সিন্ডিকেট রুখতে মধুপুরে স্বেচ্ছাসেবী ছাত্র সমাজের উদ্যোগে ন্যায্য মূল্যে সবজি বিক্রয়

রাজশাহীতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং

Reading Time: 4 minutes

মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী:
মাদক সেবন, বড় ভাইদের নির্দেশনা অনুযায়ী মিটিং মিছিল, এলোমেলো ভাবে দ্রুত গতিতে দামি মোটরসাইকেল হাকানো, বিভিন্ন ডিজাইনের চুল কাটা এবং চুলে কালার করা ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি কিশোরাই মূলত কিশোর গ্যাং-এর সদস্য। তবে এদেরকে ভালোভাবে চেনা যায় চুলের কাটিং, হাতে ব্রেসলেট, আর শরীরে মাংস তেমন নেই অর্থাৎ চিকন পাতলা গঠনের কিশোরা। এরা জানেনা তাদের ভবিষৎ কি? অল্প বুদ্ধির এই ছোট মানুষগুলিকে এক শ্রেণীর নেতা, পাতি নেতা, পাড়া মহল্লার বড় ভাই এবং রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এতে অবেগপ্রবল এই কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পাড়া মহল্লায় মারপিট, কারণে-অকারণে যাকে তাকে মারধার, দলবদ্ধভাবে আড্ডা দেয়া, বড়দের সম্মান না দেয়া এদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। রিতিমতো এদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন নগরবাসী। সম্প্রতী চন্দ্রিমা থানা এলাকায় কলোনীতে কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য এ্যানড্রয়েড ফোন কেনার দাবি নিয়ে তার চাচার কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাচা দিনমুজুর ২/৩ হাজার টাকা দিতেও চায়। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সেই দিনমুজুর ও তার ছেলেকে ব্যপক মারপিট করে। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তারা রামেকে ভর্তি হতে হয়। একই এলাকার কানার মোড়ে জনৈক স্কুল ছাত্রের কাছে ১০০ টাকা চায় কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য। টাকা না দেয়ায় ওই স্কুল ছাত্রকে ব্যপক নির্যাতন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পরে তারও স্থান হয় রামেক হাসপাতালের বেডে। এ দুই ঘটনায় চন্দ্রিমা থানায় পৃথক দু’টি অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু বড় ভাইদের দৌঁড়-ঝাঁপ আর তদবিরে শেষ পর্যন্ত থানায় অভিযোগ দু’টি মামলা হয়নি। এভাবেই আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে আদরে আদরে বাদর হয়ে যাচ্ছে কিশোর গ্যাংের সদস্যরা। চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরীতে দুইটি হত্যাকান্ড ঘটনা ঘটে। নিহত সানি ও রিয়াজ হত্যার সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্যদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর প্রকাশ্যে আসে।
র‌্যাব-৫ সূত্রে জানা যায়, সানি হত্যায় জড়িতরা একটি দুধর্ষ কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি ও ছিনতাই ছিল তাদের মূল পেশা। চাঁদাবাজি ও ছিনতাই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সানিকে তারা হত্যা করা হয়। সানি হত্যাকান্ডের আগে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটে এবং সেই হত্যাকান্ডটিও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ঘটায় বলে অভিযোগ করেন নিহতের স্বজনেরা। এছাড়াও মাথাচাড়া দিচ্ছে স্থানীয় ওয়ার্ড, স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন সংগঠনের কিশোর গ্যাং। “ডি-হট বয়েজ”, “সিএনবি বয়েজ”, “হিটার বয়েজ”, “রাজশাহী ডেঞ্জার বয়েস” (আরডিবি), “খুলিপাড়া গ্যাং”, “বিটক্যাল গ্রুপ”, “বুলেট গ্যাং”, “প্লাষ্টিক গ্রুপ”, “গুড়িপাড়া কিংস্”-এর মতো বিভিন্ন নামে চলছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের কার্যকলাপ। রাজশাহীতে দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে এসব গোষ্ঠী। এ বছর নগরীতে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্তে এ সকল কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে কিশোরগ্যাং কালচার শুরু হলেও এখন ডালপালা গজিয়েছে গোটা দেশজুড়ে, এর ভয়াল সংক্রামনে বাদ পড়েনি উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় শহর শিক্ষানগরী রাজশাহীও। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোররা। সময়ের সাথে সাথে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণরা। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার নেপথ্যে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছেন। এ ছাড়া ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমে বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। এলাকার পরিত্যাক্ত ভবন অথবা যে কোনো জায়গায় তাদের রয়েছে নিজস্ব চেম্বার, কোন কোনো সূত্র বলছে এসকল চেম্বারে রয়েছে একাধিক টর্চার সেল। রাজশাহী নগরীর মেহেরচন্ডী, খরবোনা, ছোটবড়গ্রাম, চন্ডীপুর, হেতেমখাঁ, সাবজিপাড়া, টিকাপাড়া (খুলিপাড়া) সহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয়। বিশেষ করে সিএন্ডবি এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
নগরীর টিকাপাড়া গোরস্থান এলাকার এক ব্যক্তি জানান, সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে টিকাপাড়া গোরস্থানের ভিতরে একদল কিশোর মাদক সেবন করে। সারাদিন তারা এলাকাটিকে বিভিন্ন অযুহাতে অস্থিতিশীল করে রাখে। স্থানীয়রা এইসকল কিশোর গ্যাংয়ের কার্যকলাপে অতিষ্ট হলেও অদৃশ্য দাপটের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। অন্যদিকে নগরীর সিএন্ডবি মোড়, পদ্মাগার্ডেন এলাকায় আরেকটি কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, অভিযোগ রয়েছে এসব এলাকার কিশোররা অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। তারা সক্রিয় ভাবে মাদক বেচা কেনার সাথে জড়িত থাকার পাশাপাশি, টিকটক ব্যাবহার করে নারীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এসব এলাকা গুলোতে শুধু কিশোর নয় সক্রিয় রয়েছে কিশোরীরাও।
গত (৩ জুলাই) রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে থেকে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম পাখির ছেলে কিশোর সানিকে অপহরণ করে সক্রিয় কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা। সেখান থেকে অভিযুক্তদের নিজ এলাকা হেতেমখাঁ সাহাজীপাড়ার একটি সড়কের ওপর প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায়। পরে গ্রেফতারকৃতরা সানি হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
অভিযোগ ওঠেছে, উঠতি বয়সী তরুন-তরুনীরা আবেগ ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে মাদকাশক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের টাকা যোগাড় করতে এসকল গ্যাং তৈরী হচ্ছে। ‘কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছেন। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছেন। অস্ত্রবাজি, মাদক ও হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে তারা কিশোরদের ব্যবহার করেন। এছাড়া কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এটি হলো কিশোর গ্যাং তৈরির একটি দিক। অন্য আরেকটি দিক হলো আমাদের দেশে শিশুদের লালন পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য বিষয়ে যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এসব অপরাধে জড়াচ্ছে। সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলে কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি হচ্ছে, জড়াচ্ছে নানা ধরনের অপরাধে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) নাম প্রকাশ না করা শর্তে নিউমার্কেট গোরহাঙ্গা এলাকার এক যুবক জানায়, নিউমার্কেট গোরহাঙ্গা এলাকায় ব্যপক হারে বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৈরাত্মা। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যাকে তাকে মারপিট, গালিগালাজ, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং সন্ত্রাসী কর্মকা- সহ বিভিন্ন অপরাধ চালাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। বড়দের সম্মান দিচ্ছে না। পাড়া মহললায় ছড়াচ্ছে আতঙ্ক। তাদের ভয়ে কেই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, এরা কেউই রাজশাহী মহানগরীর আদি স্থানীয় বাসিন্দা নহে। এরা বাইরে থেকে এসে এই নগরীতে বাড়ি ভাড়া করে আছে। আবার কারো কারো বাবা জমি ক্রয় করে বাড়ি বানিয়েছে। এরা মহানগরীর নিউ মার্কেট সংলগ্ন গৌরাঙ্গ এবং সুলতানাবাদ এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে এমন কর্মকান্ড চালাচ্ছে। কিছু হলেই এরা আবার অস্ত্রের মহড়া দেখায়। এদের গ্যাং এর নাম “হট বয়েজ টু”। এদের অন্যতম লিডার জনৈক বিশাল, হৃদয়, সজিব, শাওন ও রানা।
রাজশাহীতে কিশোর গ্যাং অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কার্যক্রম জানতে চাইলে, নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ রফিকুল আলম জানান, রাজশাহী মহানগরীতে আমরা ৫০০ কিশোর গ্যাং-এর তালিকা করেছি। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশকিছু তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-এর সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে যাদের বয়স একেবারেই কম তাদের মা-বাবাকে ডেকে শতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর যাদের বয়স হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও কিশোর গ্যাং-নিয়ে বিটপুলিশিং কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন থানা এলাকায় সচেতনতা মূলক বৈঠক এবং প্রচার প্রচারনা চালাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আরএমপি পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক মহাদয়ের পরামর্শে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রনে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া কিশোর গ্যাং-এর অপরাধ দমনে পুলিশ কমিশনার মহাদয়ের নিদের্শে প্রতিটি থানা অঞ্চলে অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশের পাশাপাশি মা-বাবাদের ও সচেতন হতে হবে। কিশোর ছেলের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে বলেও জানান নগর পুলিশের এই মুখপাত্র।

Please Share This Post in Your Social Media

Design & Developed BY Hostitbd.Com