শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:২৭ পূর্বাহ্ন
Reading Time: 3 minutes
হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর :
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় আব্দুল মজিদ (৫৬) নামে এক সরকারি কর্মচারি হত্যাকা-ের ঘটনার ৯দিন পেরিয়ে গেলেও আসল খুনিদের পুলিশ এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ মে। ঘটনার পর তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি পুলিশ এখনও উদ্ধার করতে পারেনি। তবে সাইদার রহমান নামে এজাহারভুক্ত এক আসামীকে গ্রেপ্তার করা হলেও অজ্ঞাতনামাসহ একজন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সম্পৃক্ত থাকলেও পুলিশ তাদের টিকিও স্পর্শ করতে পারছেন না। এ নিয়ে নিহতের পরিবার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। নিহত আব্দুল মজিদের বাড়ি পার্বতীপুর উপজেলার জমিরহাট এলাকার তকেয়াপাড়ায়। তিনি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গোপনীয় কাম উচ্চমান সহকারী (সিএ/ইউডিএ) পদে কর্মরত ছিলেন। মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী বিলকিস বেগম ওই ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকা- হিসেবে দাবী করছেন। থানায় মামলা ও বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, গত ২৮ মে বিকেলে বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সাইদার রহমান ও একই এলাকার রামকৃষ্ণপুর বিত্তিপাড়ার আবু সাঈদ নামে দুই ব্যক্তি মোবাইল ফোন করে আব্দুল মজিদকে তার নিজ বাড়ি থেকে ডেকে আনেন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরিবারের দাবি আব্দুল মজিদের সঙ্গে সাইদার রহমান, আবু সাইদ ও বদরগঞ্জের একজন প্রভাবশালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে লেনদেন ছিল। এ কারণে আব্দুল মজিদকে ডেকে ওই চেয়ারম্যানের গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে টাকা পয়সা নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন করা হয়। টাকা উদ্ধারের কৌশল হিসেবে আব্দুল মজিদকে সায়েস্থা করতে এক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে নগ্ন স্থিরচিত্র ও ভিডিও ধারণ করেন ওই চেয়ারম্যান। পরে ওই ভিডিও তার অফিসসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখানো হয়। সেখানে এক পর্যায়ে আব্দুল মজিদ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরে গোপনে এক গ্রাম্য চিকিৎসক দিয়ে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আব্দুল মজিদ নিহত হয়েছে বলে একটি নাটক সাজানো হয়। দুর্বৃত্তদের সেই কৌশলের অংশ হিসেবে ২৮ মে শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে আব্দুল মজিদকে একটি রিকশাভ্যান যোগে বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে নিয়ে যান অজ্ঞাত নামা দুই ব্যক্তি। তারা চিকিৎসক ও নার্সদের জানান, এই ব্যক্তি পার্বতীপুর-রংপুর সড়কের বদরগঞ্জ পৌরশহরের সিও অফিস সেতুর কাছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন। আমরা তাকে দেখার পর হাসপাতালে নিয়ে আসি। এসময় আব্দুল মজিদের পকেটে শুধুমাত্র একটি মোবাইল ফোন সেট পাওয়া যায়। এ ঘটনার কয়েক মিনিট পরেই হাসপাতালে মরদেহ ফেলে সঠকে পড়েন অজ্ঞাতনামা ওই দুই ব্যক্তি। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এসময় মরদেহের কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইল ফোনের সুত্র ধরে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জানতে পারেন তার নাম আব্দুল মজিদ। তিনি বিরামপুর ইউএনও অফিসের কর্মচারী। তার বাড়ি বদরগঞ্জ সীমান্তের পার্বতীপুরের জমিরেরহাটে বাড়ি। পরের দিন পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে রংপুর মর্গে পাঠায়। এ ঘটনায় প্রথমে অপমৃত্যু মামলা হয়। পরে নিহতের স্ত্রী বিলকিস বেগম বাদী হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দুইজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে বদরগঞ্জ থানার মামলা করেন। পুলিশ গত বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়ে সাইদার রহমান গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। রবিবার ( ৫জুন) তার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করে রিমা-ে নেওয়া হতে পারে বলে পুলিশের সুত্র জানায়। এদিকে মামলায় উল্লেখ করা হয়, আব্দুল মজিদের সাথে বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য সাইদার আলীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এ কারণে সাইদার মেম্বার জমি বিক্রির কথা বলে পর্যায়ক্রমে ২৫ লাখ টাকা আব্দুল মজিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন। এরপর তিনি জমি লিখে দেওয়ার নামে নানা ধরণের টালবাহানা করতে থাকেন। একারণে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ২৮মে সাইদার মেম্বার ও আবু সাঈদ জমির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আব্দুল মজিদকে এক ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সমঝোতার কথা বলে বদরগঞ্জে ডেকে নিয়ে ঠা-া মাথায় খুন করে লাশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেখে পালিয়ে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক বিশ্বস্থ সুত্র থেকে জানা যায়, সরকারি কর্মচারি খুনের পেছনে একটি বড় চক্র জড়িত। এ ঘটনার মাস্টার মাইন্ড একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি এক সময় শিবিরের ক্যাডার ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাড়িতে তালা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। এদিকে ঘটনার সময় আব্দুল মজিদের মরদেহ কারা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তা সনাক্ত করার জন্য হাসপাতালের সব ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায় ২৮ তারিখ দুপুর ১টা ৫১ মিনিট থেকে ২৯ তারিখ সকাল ৯টা ২১ মিনিট পর্যন্ত সব ক্যামেরা বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে হাসপাতাল থেকে কোন ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা যায়নি। তবে ঘাতকদের মধ্যে একজনের ভিজিও ফুটেজ পাওয়া গেছে হাসপাতালের সামনে থাকা একটি ঔষুধের দোকানের সিসি ক্যামেরায়। তাকে সনাক্ত করেন হাসপাতালের এক কর্মচারি। ওই ভিডিও ফুটেজটি এখন এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঘাতকদের মধ্যে এক ব্যক্তি মরদেহ হাসপাতালে রেখে বাইরে এসে রাস্তায় উদ্বেগজনক অবস্থায় হাটাহাটি করছেন। এসময় একটি মোটরসাইকেল উঠে তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যান।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) নুর আলম সিদ্দিক বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে সাইদার রহমান নামে এক সাবেক মেম্বারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাইদার মেম্বার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এ ঘটনার সঙ্গে যদি কোন জন প্রতিনিধি জড়িত থাকে তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে। মামলার অপর আসামি আবু সাঈদসহ অজ্ঞাতদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। এছাড়াও আব্দুল মজিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করতে পুলিশী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বদরগঞ্জ থানার ওসি হাবিবুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে রিমা-ের আবেদন করা হয়েছে। রিমা- মঞ্জুর হলে এ ঘটনার আর কারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করা হবে। এতে কোন ইউপি চেয়ারম্যান কিংবা অন্য কেউ জড়িত থাকলেও তাদেরকেও ছাড় দেওয়া হবে না।